“পর্তুগালের জন্য, যদি আমার পা ভেঙে যেত, তবুও খেলতাম”— এই একটি বাক্যেই যেন তাঁর গোটা ক্যারিয়ারের গল্প ফুটে ওঠে। মাইক্রোফোনের সামনে দাঁড়িয়ে যখন কথাগুলো বলছিলেন, তখন চোখ ছিল জলে ভেজা। সেটা কেবল আনন্দের অশ্রু নয়, সেটি এক দীর্ঘ পথচলার শেষ অধ্যায়ের প্রতিচ্ছবি। বয়স চল্লিশ পার করেছে তাঁর শরীর, হাঁটুতে পুরোনো ব্যথা মাথাচাড়া দিয়েছে বারবার। তবুও জাতীয় দলের জার্সিতে রোনালদোর নিবেদন, ত্যাগ ও ভালোবাসার এমন নজির ফুটবল ইতিহাসে বিরল।
উয়েফা নেশনস লিগ ২০২৫-এর ফাইনাল মঞ্চে প্রতিপক্ষ ছিল ইউরোপের অন্যতম শক্তিশালী দল স্পেন। মিউনিখের আলো ঝলমলে স্টেডিয়ামে খেলা শুরু হয়েছিল দুই দলের পারস্পরিক আক্রমণ-পাল্টা আক্রমণে। ম্যাচের শুরুতে পিছিয়ে পড়ে পর্তুগাল। একবার নয়, দুইবার। কিন্তু রোনালদোর নেতৃত্বে দলটি ঘুরে দাঁড়ায়। প্রথম গোল আসে নুনো মেন্ডেজের পা থেকে, আর দ্বিতীয় গোলটি করেন সেই মানুষটি, যার হাঁটুতে তখন ব্যথা, যিনি প্রায় খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে খেলছিলেন— হ্যাঁ, তিনিই রোনালদো।

আরও পড়ুন: ইয়ামালের স্পেনকে হারিয়ে চ্যাম্পিয়ন রোনালদোর পর্তুগাল
তার ঠিক পরেই খেলা গড়ায় অতিরিক্ত ৩০ মিনিটে, কারণ ৯০ মিনিট শেষে স্কোরলাইন ছিল ২-২। কিন্তু সেখানেও সমতা ভাঙেনি। অতঃপর, চ্যাম্পিয়ন নির্ধারণ হয় টাইব্রেকারে। ততক্ষণে ৮৮ মিনিটে রোনালদোকে তুলে নিয়েছিলেন কোচ রবার্তো মার্টিনেজ। তবে মাঠের বাইরে থাকলেও ডাগআউটে বসে রোনালদো যেন ছিলেন সবচেয়ে বড় অনুপ্রেরণা। ক্যামেরার ফোকাস বারবারই ধরা দেয় তাঁর দিকে। টাইব্রেকারের শুরুতে দেখা যায়, হাত তুলে প্রার্থনার ভঙ্গিতে কিছু একটা পড়ছেন রোনালদো। সেই প্রার্থনাই যেন আশীর্বাদ হয়ে আসে পর্তুগালের জন্য। তারা স্পেনকে ৫-৩ ব্যবধানে হারিয়ে তুলে নেয় নেশনস লিগের শিরোপা।
রুবেন নেভেস যখন পঞ্চম শটে গোল করে নিশ্চিত করেন পর্তুগালের জয়, তখন কান্নায় ভেঙে পড়েন রোনালদো। তাঁর এই কান্না পরাজয়ের নয়, এক পরিপূর্ণ অধ্যায়ের সার্থকতার। ম্যাচ শেষে মাইক্রোফোনের সামনে দাঁড়িয়ে আবেগময় কণ্ঠে বলেন, “এই আনন্দ অসাধারণ। প্রথমত, এই প্রজন্মের জন্য, তারা একটা বড় শিরোপার প্রাপ্য ছিল। দ্বিতীয়ত, আমার পরিবার এখানে ছিল। আমার স্ত্রী, সন্তান, ভাই আর বন্ধু সবাই এসেছে। এই জয় তাদের জন্যও।”
আরও পড়ুন: দেশের জন্য ভাঙা পায়েও লড়বেন রোনালদো

রোনালদোর এই গোলের মধ্য দিয়ে আন্তর্জাতিক ফুটবলে তাঁর গোলসংখ্যা আরও সমৃদ্ধ হলো, সংখ্যায় যা ১৩৮। এই টুর্নামেন্টেই ৯ ম্যাচে ৮ গোল করে হয়েছেন শীর্ষ গোলদাতা। সেমিফাইনালেও করেছিলেন একটি নির্ণায়ক গোল। অর্থাৎ, প্রায় একা হাতেই পর্তুগালকে টেনে তুলেছেন ফাইনালে এবং এনে দিয়েছেন শিরোপা। বয়স চল্লিশের কাঁটা পেরোলেও তাঁর শরীর যেন এখনো আত্মবিশ্বাসে ভরপুর, মনের শক্তিতে তরুণদের চেয়েও দৃঢ়। তাঁর কথাতেই বোঝা যায়, “ওয়ার্মআপ থেকেই ব্যথা অনুভব করছিলাম। অনেকদিন ধরেই এটা ভোগাচ্ছে। কিন্তু আমি জানতাম, দেশের জন্য খেলতেই হবে। সব উজাড় করে দিতে হবে।”
এই জয়ে রোনালদোর আন্তর্জাতিক শিরোপার সংখ্যা দাঁড়াল তিনটিতে। ইউরো ২০১৬, নেশনস লিগ ২০১৯ এবং এবার ২০২৫-এর নেশনস লিগ। এর বাইরে নিজের প্রথম আন্তর্জাতিক টুর্নামেন্টেই ২০০৪ সালে দলকে তুলেছিলেন ফাইনালের মঞ্চে। ২০১৬ সালের ইউরো চ্যাম্পিয়নশিপে পর্তুগালকে একা হাতে গ্রুপ পর্ব থেকে টেনে তুলেছিলেন। গোল করেছিলেন গুরুত্বপূর্ণ সেমিফাইনালেও। ২০১৯ সালেও নেশন্স লিগের সেমিফাইনালে পেয়েছিলেন হ্যাটট্রিক। এবারও সেই একই রোনালদো। সময় পরিবর্তন হলেও, রোনালদো যেনো রয়ে গেছেন সেই একই রুপেই।

এক সময় যে দেশটি ফাইনালে উঠতেই পারত না, সেই পর্তুগালকে তিনি টেনে এনেছেন চারটি বড় ফাইনালে, যার তিনটিই জয় দিয়ে রাঙিয়েছেন। ক্লাব ফুটবলে রোনালদোর সাফল্য অজস্র—ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড, রিয়াল মাদ্রিদ, জুভেন্টাসে ট্রফির পর ট্রফি। তবে জাতীয় দলের হয়ে এই আবেগ, এই কান্না যেন তাঁর গল্পকে করে তোলে আরও গভীর।
আরও পড়ুন: রোনালদোর গোলে ফাইনালে পর্তুগাল
ফাইনালের আগে আলোচনার কেন্দ্রে ছিলেন স্পেনের ১৭ বছরের বিস্ময়বালক লামিনে ইয়ামাল। অনেকেই ভেবেছিল, হয়তো এই ম্যাচে দেখা যাবে এক প্রজন্মের উত্থান, অন্য প্রজন্মের বিদায়। কিন্তু বাস্তবতা হলো ভিন্ন। ইয়ামালকে প্রশংসায় ভাসিয়ে রোনালদো বলেন, “সে এক বিস্ময়। অনেক লম্বা ক্যারিয়ার অপেক্ষা করছে ওর সামনে। এই নেশনস লিগ বহুবার জিতবে ইয়ামাল।” যেন এক কিংবদন্তি আরেক সম্ভাব্য কিংবদন্তিকে আশীর্বাদ করে গেলেন।
তবে আসল কৃতিত্ব যার, তিনি কোচ রবার্তো মার্টিনেজ। রোনালদোর ভাষায়, “তিনি একজন স্প্যানিশ, কিন্তু আমাদের দেশের জন্য সব দিয়েছেন। এই ক্ষুধা, এই মোটিভেশনই আমাদের এগিয়ে নিয়ে যায়।” মার্টিনেজের দূরদর্শী পরিকল্পনা, তরুণ-প্রবীণ মিশ্রণে গড়া স্কোয়াড, আর রোনালদোর নেতৃত্বে পর্তুগাল হয়ে উঠেছে একটি ইউনিট— যারা কেবল ট্যালেন্ট নয়, আবেগ, আত্মত্যাগ আর সংহতির প্রতীক।

ম্যাচ শেষে যখন মিউনিখের আকাশে লাল-সবুজ পতাকা উড়ছিল, তখন মাঠে একা দাঁড়িয়ে ছিলেন রোনালদো। চোখে জল, হাতে পতাকা। সেটি কেবল একটি ম্যাচের স্মৃতি নয়, সেটি এক দীর্ঘ অধ্যায়ের ক্লাইম্যাক্স। রোনালদো জানেন, হয়তো এটি তাঁর শেষ আন্তর্জাতিক ফাইনাল, হয়তো তিনি আর ফিরবেন না এমন বড় মঞ্চে। কিন্তু যা তিনি রেখে গেলেন, তা হলো একটি প্রজন্মের আত্মবিশ্বাস, একটি জাতির গর্ব, এবং ফুটবলের ইতিহাসে অমলিন এক অধ্যায়।
আরও পড়ুন: হামজা-জামালদের ম্যাচে নজরদারিতে থাকছে সোয়াট
এই ফাইনাল কেবল ট্রফির লড়াই ছিল না। এটি ছিল এক যোদ্ধার জীবনের শ্রেষ্ঠ যুদ্ধ। যে যুদ্ধ তাঁর বয়স, চোট আর সময়ের বিরুদ্ধে। আর সেই যুদ্ধে জয়ী হলেন রোনালদো—শুধু পায়ের জোরে নয়, হৃদয়ের শক্তিতে। তিনি প্রমাণ করলেন, ‘প্যাশন যদি থাকে, তবে বয়স কেবলই একটি সংখ্যা।’