লিওনেল আন্দ্রেস মেসি, ফুটবল মাঠে এই নামটাই যেন আলাদা এক জাদুর মতো। তার পায়ে বল মানেই যেন চোখধাঁধানো পাসিং, মনোমুগ্ধকর ড্রিবলিং আর দুর্দান্ত সব গোল। ক্যারিয়ারের শুরু থেকে এখন পর্যন্ত একের পর এক গোল করেই গেছেন আর্জেন্টিনার এই মহাতারকা। এখন পর্যন্ত সব ধরনের প্রতিযোগিতা মিলিয়ে মেসির গোলসংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৮৬০টি। এর মধ্যে অনেক গোলই ছিল দর্শনীয়, আবার অনেকগুলো এসেছে ম্যাচের মহাগুরুত্বপূর্ণ মুহূর্তে।
আরও পড়ুন: রিয়ালের ইতিহাসের পাতায় ইতি টানছেন লুকা মদ্রিচ
এই অসংখ্য গোলের মধ্য থেকে একটি গোল বেছে নিতে বললে তা নিশ্চয়ই অনেক বড় চ্যালেঞ্জ। কিন্তু মেসি সেই কঠিন কাজটাই করেছেন। নিজের করা প্রিয় গোল হিসেবে বেছে নিয়েছেন এমন একটি গোল যেটি কিনা সাধারণ চোখে খুব আহামরি কিছু মনে নাও হতে পারে। তবে সবচেয়ে অবাক করা ব্যাপার হলো তিনি বেছে নিয়েছেন হেডে করা একটি গোল।

মেসির খেলার ধরনেই বোঝা যায় তিনি মাটি ঘেঁষা ফুটবলে বেশি স্বচ্ছন্দ। ছোটখাটো গড়ন, দ্রুত পায়ের গতি এবং নিখুঁত কন্ট্রোলের জন্য পরিচিত মেসির হেডে গোল করাটা বেশ বিরল। এতটাই বিরল যে, ৮৬০ গোলের মধ্যে হেডে তার গোল মাত্র ২৮টি। তুলনা করতে গেলে, ক্রিস্টিয়ানো রোনালদোর হেডে গোল সংখ্যা ১৫৪টি। এত কম হেডে গোল করলেও, মেসির প্রিয় গোল কিন্তু সেই হেড থেকেই। গোলটি এসেছে ২০০৯ সালের চ্যাম্পিয়নস লিগ ফাইনালে, ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডের বিপক্ষে।
আরও পড়ুন: রোনালদো জুনিয়রের জোড়া গোলে চ্যাম্পিয়ন পর্তুগাল
২০০৯ সালের ২৭ মে, রোমের অলিম্পিকো স্টেডিয়ামে ইউরোপ সেরা হওয়ার লড়াইয়ে মুখোমুখি হয়েছিল বার্সেলোনা ও ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড। ম্যাচের ৭০ মিনিটের মাথায়, ডান প্রান্ত থেকে একটি নিখুঁত ক্রস পাঠান জাভি হার্নান্দেজ। বক্সের ভেতর ফাঁকায় দাঁড়িয়ে থাকা মেসি লাফিয়ে উঠে মাথা দিয়ে বল জালে জড়িয়ে দেন। গোলরক্ষক এডউইন ভ্যান ডার সার কিছুই করার ছিল না। বার্সেলোনা তখন এগিয়ে যায় ২–০ ব্যবধানে। আর পরে সেই একই ব্যবধানে জিতে নেয় ম্যাচটি। গোলটি দেখতে সাধারণ মনে হলেও, এর তাৎপর্য ছিল অনেক বড়। সেটি ছিল মেসির ক্যারিয়ারের প্রথম চ্যাম্পিয়নস লিগ ফাইনাল গোল এবং গার্দিওলার স্বপ্নের বার্সেলোনার ইউরোপ জয়ের শুরুর মুহূর্ত।

অনেকেই প্রশ্ন করতে পারেন, ২০১৫ সালের কোপা দেল রে ফাইনালে অ্যাথলেটিক বিলবাওয়ের বিপক্ষে ফিজিক্সকে হারমানানো সেই বিখ্যাত গোল, বা ২০০৭ সালে হেতাফের বিপক্ষে ম্যারাডোনা-স্মৃতির সেই আনকারা মেসি গোল, কিংবা চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী রিয়াল মাদ্রিদের বিপক্ষে ২০১১ চ্যাম্পিয়নস লিগের সেমিফাইনালে করা দুর্দান্ত গোল, এগুলো নয় কেন?
আরও পড়ুন: আকবরের ব্যাটে প্রত্যাবর্তনের ঝলক
মেসির উত্তরটা বেশ সরল, কিন্তু আবেগঘন। তার ভাষায়, “আমার অনেক গোল আছে যেগুলো সম্ভবত এই গোলের চেয়ে অনেক সুন্দর এবং অনেক বেশি মূল্যবান। কিন্তু চ্যাম্পিয়নস লিগ ফাইনালে ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডের বিপক্ষে করা এই হেডারটিই আমার সব সময়ের পছন্দের।”

এই বিশেষ গোলটির সম্মানেই একটি চ্যারিটি প্রকল্প হাতে নিয়েছে ইন্টার মায়ামি ফাউন্ডেশন। ‘গোল ইন লাইফ’ নামের এই উদ্যোগের অংশ হিসেবে মেসির সেই হেডে গোলকে রূপ দেওয়া হবে একটি চিত্রকর্মে। যেটি তৈরি করবেন বিখ্যাত শিল্পী রেফিক আনাদোল। মেসি ও আনাদোল দুজনই এই শিল্পকর্মে স্বাক্ষর করবেন। এরপর সেটিকে নিউইয়র্কের বিখ্যাত নিলাম প্রতিষ্ঠান ক্রিস্টির মাধ্যমে আগামী ১১ জুন প্রকাশ করা হবে এবং নিলামে তোলা হবে ১১ জুলাই পর্যন্ত। এই উদ্যোগ থেকে প্রাপ্ত অর্থ ব্যয় করা হবে নানা চ্যারিটি কর্মকাণ্ডে।
আরও পড়ুন: ডেথ ওভারে মুস্তাফিজই ডট বলের রাজা
মেসি নিজেই এই উদ্যোগে দারুণ রোমাঞ্চিত। তিনি বলেন, “আমি জানি, রেফিকের কাজ কতটা বিশেষ। আমরা মায়ামিতে দেখা করছিলাম এবং এখন সে কীভাবে এই গোলটিকে, খেলার মুহূর্তটিকে একটি অনন্য শিল্পকর্মে রূপ দিতে পারে, সেটা আবিষ্কার করা রোমাঞ্চকর ব্যাপার হবে।”
মেসির ক্যারিয়ারে এমন অনেক গোল আছে যা হয়তো ভক্ত-সমর্থকদের চোখে শ্রেষ্ঠ। কিন্তু যে গোলটা তার হৃদয়ে গেঁথে আছে, সেটি হয়তো পরিসংখ্যানে অতটা জাঁকজমকপূর্ণ না হলেও, আবেগ-অনুভূতির দিক থেকে ঠিকই শীর্ষের কাতারে। সেই গোলটিকেই এবার দেখা যাবে ক্যানভাসে, রঙে রঙে আঁকা এক নিদারুণ শিল্পকর্মে।