গ্যালারিতে উদযাপনের প্রস্তুতিই নিয়ে ফেলছিলেন হ্যারি কেইন। ক্যারিয়ারের প্রথম শিরোপা বলে কথা! চোখেমুখে তৃপ্তির আভাস, হৃদয়ে ধীরে ধীরে জমতে থাকা বাঁধভাঙা আবেগ— সব প্রস্তুত ছিল এক ঐতিহাসিক মুহূর্তের জন্য। তবে ভাগ্যের নির্মম পরিহাসে অনেকটাই নিশ্চিত শিরোপাও যেন সোনার হরিণ হয়ে দাঁড়ালো। শেষ মুহূর্তের হতাশায় কেইনের ট্রফি ছোঁয়ার অপেক্ষা বাড়লো আরও কিছুটা সময়।
৮৩ মিনিটে যখন লিরয় সানে গোল করে বায়ার্ন মিউনিখকে এগিয়ে দিলেন, তখন কেইনের মুখে ফুটে উঠেছিল কাঙ্ক্ষিত স্বপ্নের হাসি। নিষেধাজ্ঞার কারণে মাঠে না থাকলেও দর্শকসারিতে বসেই যেন হৃদয়ে বাজছিল বিজয়ের ঘণ্টা। ক্যামেরাও তখন দ্রুত মাঠ থেকে ঘুরে গেল গ্যালারির দিকে, যেখানে পাঞ্জা উঁচিয়ে উচ্ছ্বাসে মাতছিলেন হ্যারি কেইন। এমন উদ্যাপন তো আর রোজ হয় না— এটা ছিল এমন এক মুহূর্ত, যার জন্য তিনি অপেক্ষা করেছিলেন ১৬ বছর।

আরও পড়ুন: ক্রিকেট থেকে অস্থায়ীভাবে নি’ষিদ্ধ কাগিসো রাবাদা
কিন্তু অতিরিক্ত সময়ের শেষ মুহূর্তে ইউসুফ পুলসেনের গোল— সে যেন সব উচ্ছ্বাসে ছাই ঢেলে দিল। ৩-৩ গোলের ড্র নিয়ে মাঠ ছাড়তে হলো বায়ার্নকে। অথচ, এই ম্যাচে জয় আসলেই নিশ্চিত হতো বুন্দেসলিগা শিরোপা। সেই আনন্দের ক্ষণটুকু এসে থেমে গেল সময়ের করুণ প্রতীক্ষায়।
তবুও এবারের মৌসুমে জার্মান এই লিগের সামগ্রিক চিত্র বলে দেয়, অপেক্ষা কেবল সময়ের। বুন্দেসলিগায় ৩২ ম্যাচ শেষে বায়ার্নের পয়েন্ট ৭৬। দ্বিতীয় স্থানে থাকা লেভারকুজেনের পয়েন্ট ৬৭, হাতে আছে তিনটি ম্যাচ। বায়ার্ন তাদের বাকি দুই ম্যাচে হেরে গেলেও, এবং লেভারকুজেন তিনটিতেই জিতলেও, পয়েন্টে সমতা আসবে। কিন্তু গোল ব্যবধানে অনেক এগিয়ে থাকা বায়ার্ন তখনও থাকবে শীর্ষে। ফলে আনুষ্ঠানিক ঘোষণাটুকু বাকি থাকলেও, বাস্তবতা বলছে— শিরোপা প্রায় নিশ্চিত।
আর এই ‘প্রায়’-এর যন্ত্রণাই যেন সবচেয়ে বেশি পোড়াচ্ছে কেইনকে। টটেনহামে ১৪ বছরের অধ্যায়, ইংল্যান্ডের হয়ে ইউরো ফাইনাল, চ্যাম্পিয়ন্স লিগের শেষ মঞ্চ— সবখানেই বারবার ফিরে আসা শূন্য হাতে। বায়ার্নে পা দিয়েই চাওয়া ছিল বদলে যাওয়া গল্পের। অথচ, সুপার কাপ দিয়ে শুরু হয়েছিল হতাশার। এরপর লিগে গোলের বন্যা বইয়ে দিয়েও ট্রফির ছোঁয়া ছিল অধরাই। এখন যখন হাতে ছোঁয়া দূরত্বে, তখনও সেটিকে অধরা করে রাখলো শেষ মুহূর্তের এক গোল।

তবে এই গল্পটা শুধু ফুটবলের নয়, এটি এক মানবিক লড়াইয়ের চিত্রও। কেইনের ক্যারিয়ার যেন ঠিক একটা ক্লাসিক ট্র্যাজেডির কাহিনি। যেখানে নায়ক অক্লান্ত পরিশ্রম করেন, কষ্টে বুক ভাসান, নিজের সেরাটা দিয়ে যান প্রতিটি দিন, অথচ মঞ্চের শেষে দাঁড়িয়ে পান না কাঙ্ক্ষিত পুরস্কার। তাঁর এই যাত্রা শুধুই পরিসংখ্যান দিয়ে বিচার করা সম্ভব নয়। এটা একজন খেলোয়াড়ের হৃদয়ের গভীরতম স্বপ্নকে ছোঁয়ার চেষ্টা, যা বারবার ব্যর্থ হলেও থামে না।
টটেনহ্যাম হটস্পারে তাঁর দিনগুলো ছিল ইতিহাস গড়ার। ক্লাবের সর্বোচ্চ গোলদাতা, লিগের অন্যতম সেরা স্ট্রাইকার, ইংল্যান্ডের হয়ে রেকর্ড ভাঙা পারফরম্যান্স—সবই ছিল তার ঝুলিতে। শুধু একটি জায়গাতেই ফাঁকা ছিল ট্রফির তাক। বারবার সেই শূন্যতা পূরণ করতে গিয়ে দেখা পেয়েছেন হতাশার। কখনও ফাইনালের বাঁশিতে থেমে গেছে স্বপ্ন, কখনও গোলপোস্টে লেগে ফিরে এসেছে ভাগ্য।
বায়ার্নে এসে কেইন যেন ভেবেছিলেন— এবার না হয় সব পেছনে ফেলে নতুন অধ্যায় শুরু হবে। মাঠে তিনি তাই প্রমাণও রাখলেন নিজের শ্রেষ্ঠত্বের। এবারের বুন্দেসলিগা মৌসুমে কেইনের গোলসংখ্যা ২৪ এর ঘরে, তবুও, একবারের জন্যও তিনি বলেননি, “আমার কাজ শেষ।” কারণ, তাঁর চোখ ছিল ট্রফির দিকে। দলকে শিরোপা এনে দেওয়ার দিকেই।
তাই হয়তো লাইপজিগের বিপক্ষে ম্যাচে মাঠে না থেকেও, গ্যালারিতে বসে উদ্যাপনের প্রস্তুতি নিয়ে ফেলেছিলেন তিনি। যখন সানে গোল করলেন, তখন সেই দৃশ্য শুধু একটি মুহূর্ত ছিল না— এটা ছিল একটি জীবনের প্রতিচ্ছবি।

অথচ ম্যাচের প্রথমার্ধেই দুই গোল খেয়ে পিছিয়েই গিয়েছিল বায়ার্ন। শুরুর ৪৫ মিনিট শেষে ২-০ গোলে পিছিয়ে থেকেই ডাগআউটেও ফিরে যায় বাভারিয়ানরা। তবে দ্বিতীয়ার্ধেই সেই ২ গোলের গ্যাপ কমিয়ে এনে একসময় ৩-২ গোলে এগিয়েও যায় বায়ার্ন মিউনিখ। কিন্তু, শেষ পর্যন্ত ৩-৩ গোলের ড্র নিয়েই ফিরেছে দুই দল।
আরও পড়ুন: লঙ্কানদের উড়িয়ে ১৪৬ রানের জয় যুবাদের
তবুও হয়তো আগামী সপ্তাহেই বা ঘরের মাঠে মনশেনগ্লাডবাখের বিপক্ষে ম্যাচেই ফুটে উঠবে সেই মুহূর্ত— যেখানে বর্ণিল আলোয় উদ্যাপন করবেন হ্যারি কেইন। হাতে থাকবে তাঁর ক্যারিয়ারের প্রথম শিরোপা। শুধু একটি পয়েন্ট, শুধু একটু সময়—তারপরেই হয়তো কোনো এক আকাশের নিচে দাঁড়িয়ে, চোখ বন্ধ করে, বুক ভরে শ্বাস নিয়ে বলবেন— শেষমেশ পেরেছিলাম।

কারণ ফুটবল সবসময় পরিসংখ্যানের খেলা নয়। এটা আবেগ, বিশ্বাস আর প্রতীক্ষার গল্প। আর হ্যারি কেইনের প্রতীক্ষা যদি সফল হয়, তবে সেটি শুধু একটি ট্রফি জয়ের গল্প হবে না— এটি হবে বিশ্বাসের জয়, অধ্যবসায়ের জয়, এবং এক সত্যিকারের নায়কের পরিণতির জয়।