বুধবার, জুন ২৫, ২০২৫
সামি'স কর্নার

জানাকে সাথে নিয়েই এনরিকের ট্রেবল জয়

সব ছবি শুধু চোখের দেখার জন্য নয়, কিছু ছবি থেকে যায় হৃদয়ের গভীর কোণে। কিছু মুহূর্ত সময় পেরিয়ে বার বার ফিরে আসে। তেমনি এক ছবি দিয়ে শুরু হয়েছে এই গল্পটা। লুইস এনরিকে দাঁড়িয়ে আছেন জার্মানির বার্লিনের অলিম্পিক স্টেডিয়ামে, কোমরে হাত দিয়ে, মুখে মিটিমিটি হাসি। পাশে তাঁর ছোট্ট মেয়ে জানা, হাতে বার্সেলোনার পতাকা, যেন পৃথিবীর সবচেয়ে নির্ভেজাল উল্লাসে ডুবে আছে এনরিক কন্যা জানা।

আরও পড়ুন: মেসির হাতেই ইন্টার মিয়ামির সর্বোচ্চ গোলের গৌরব

ছবিটা ২০১৫ সালের। লুইস এনরিকে তখন স্প্যানিশ জায়ান্ট বার্সেলোনার কোচ। মাত্রই জুভেন্টাসকে হারিয়ে নিজের কোচিং ক্যারিয়ারের প্রথম ট্রেবল জিতেছেন এনরিকে। বার্সেলোনার জয়, কোচ হিসেবে প্রথম ট্রেবল জয় নিজের মেয়ের সাথে এভাবে উদযাপন, সব মিলিয়ে ফুটবলের অন্যতম শ্রেষ্ঠ গল্পের একটি দৃশ্য ছিলো এটি। অথচ কে জানত, কয়েক বছর পর এই ছবিই হয়ে উঠবে হৃদয় ভাঙার এক প্রতীক।

২০১৫ সালের সেই ছবি এখন আর আগের মতো আনন্দ এনে দেয় না, বরং অশ্রুসিক্ত চোখে ভাসায়। কারণ, জানা এখন আর নেই। ২০১৯ সালের শেষভাগে ক্যানসারের সঙ্গে দীর্ঘ পাঁচ মাসের সংগ্রাম শেষে পৃথিবী থেকে চিরবিদায় নেয় মাত্র নয় বছর বয়সী সেই ছোট্ট শিশু। জানার মৃত্যুর আগে এনরিকে ছিলেন স্পেন জাতীয় দলের কোচ। অথচ মেয়ের অসুস্থতার খবর পাওয়ার পর এক মুহূর্ত অপেক্ষা না করে ছেড়ে দেন জাতীয় দলের দায়িত্ব। মিডিয়াতে কোনো ব্যাখ্যা দেন না, সংবাদ সম্মেলনে যান না, এমনকি ঘনিষ্ঠদের সঙ্গে কমিয়ে দেন যোগাযোগ।

আরও পড়ুন: বিপিএলে টিকিটের আয়-ব্যয়ের হিসাব দিলো বিসিবি

নিজের ছোট্ট মেয়ের পাশে দাঁড়াতে তিনি ছেড়ে দেন কোচিং, সাফল্য, স্বীকৃতি, সবকিছু। জানার জীবনটা ধীরে ধীরে ফুরিয়ে আসছিল, আর এনরিকে যতটা সম্ভব তাঁকে ধরে রাখার চেষ্টা করছিলেন। একজন কোচের জীবনে অনেক ট্যাকটিকস, অনেক পরিকল্পনা থাকে, কিন্তু মেয়ের ক্যানসারের বিরুদ্ধে কোনো গেম প্ল্যান কাজে আসে না। এখানে হার মানেই এক চিরস্থায়ী শূন্যতা।

জানার মৃত্যুর খবর আসে হঠাৎ করেই। সংবাদমাধ্যম যখন জানায়, ফুটবলবিশ্ব থমকে যায়। সেই হাসিমাখা ছবির শিশুটি আর নেই! এক বাবার জীবন যেন হঠাৎ থেমে যায়, অথচ পৃথিবী থেমে থাকে না। সব হারিয়েও এনরিকে আবার ফিরে আসেন ফুটবলে। ফিরে আসেন স্পেন দলের দায়িত্ব নিয়ে, পরবর্তীতে পিএসজির কোচও হয়েছেন। তবে যারা তাকে ভালোভাবে চেনে তারা বুঝতে পারে সেই এনরিকের মধ্যে কতটা পরিবর্তন এসেছে।

আরও পড়ুন: ইন্টারকে উড়িয়ে মিউনিখে চ্যাম্পিয়নস লিগ জিতলো পিএসজি

ফুটবল তাঁর কাছে তখন আর কোনো পেশা না। প্রতিটি ম্যাচ, প্রতিটি জয় যেন নিজের কন্যার উদ্দেশ্যে দেওয়া এক বার্তা, ‘তোমার জন্য আমি এখানেই আছি, আমি হারিনি।’ ২০২৫ সালের মে মাসের শেষ রাতে যেন সেই বার্তাটাই বড় করে লেখা হয়ে গেল। মিউনিখের অ্যালিয়াঞ্জ অ্যারেনায় চ্যাম্পিয়নস লিগের ফাইনালে পিএসজি মুখোমুখি হয় ইন্টার মিলানের। এবং এরপর যা ঘটে, তা ইউরোপিয়ান ফুটবলের ইতিহাসের পাতায় লেখা থাকবে স্বর্ণাক্ষরে।

পিএসজি ৫-০ গোলে উড়িয়ে দেয় ইন্টারকে। ইউরোপীয়ান ফুটবলের শ্রেষ্ঠত্বের লড়াইয়ে এমন একপেশে লড়াই আগে কখনোই দেখেনি ফুটবল বিশ্ব। প্রথমবারের মতো চ্যাম্পিয়নস লিগ জয়, ট্রেবল সম্পূর্ণ করা, সবকিছু মিলিয়ে পিএসজির ইতিহাসেও এটা ছিলো অবিস্মরণীয় এক রাত। কিন্তু সবচেয়ে গভীর ও স্পর্শকাতর মুহূর্তটা আসে খেলার শেষে। ক্যামেরায় ধরা পড়ে এনরিকে আর তাঁর গায়ে একটি কালো টি-শার্ট।

আরও পড়ুন: ফারুক আহমেদকে অপসারণের কারণ জানালেন ক্রীড়া উপদেষ্টা 

সেই টি-শার্টে ছিলো এক স্কেচ। তাতে একজন বাবা পতাকা পুঁতছেন মাঠে, আর পাশে দাঁড়িয়ে তাঁর মেয়ে। এ যেন ২০১৫ সালের সেই ছবিরই পুনরাবৃত্তি, তবে এবার জানা বাস্তবে নেই। তবুও তার উপস্থিতি একেবারে স্পষ্ট। এনরিকের সাথে এই মুহূর্তটা বরণ কর নিয়েছে পিএসজি সমর্থকেরাও। গ্যালারিতে নিয়ে আসে বিশাল এক তিফো। তাতে সেই একই ছবি, এনরিকে আর জানা। জানা এবার পিএসজির জার্সি পরে, পিঠে লেখা ৮ নম্বর। প্যারিসের ভক্তরা, যাঁরা জানাকে কখনও দেখেননি, তাঁর জন্য ব্যানারে, পোস্টারে, গানে ভালোবাসা দেখাতে একদমই ভোলেনি।

গত জানুয়ারিতে স্প্যানিশ সংবাদমাধ্যম মার্কাকে এনরিকে বলেছিলেন, “বার্লিনে চ্যাম্পিয়নস লিগ জয়ের পর আমার সঙ্গে তার একটি অবিশ্বাস্য ছবি মনে আছে। মাঠে বার্সেলোনার পতাকা পোঁতার ছবি। আশা করি, পিএসজির সঙ্গেও এটা করতে পারব।আমার মেয়ে সেখানে (ফাইনাল) শারীরিকভাবে থাকবে না। কিন্তু আধ্যাত্মিকভাবে থাকবে, আর এটা আমার কাছে গুরুত্বপূর্ণ।” সে স্বপ্নও যেন সত্যি হয়ে গেল। বাস্তবে জানা সঙ্গে নেই, তবুও যেন প্রতিটি মুহূর্তে বাবা এনরিকের সাথে ছায়া হয়ে ছিলেন।

আরও পড়ুন: বাংলাদেশ-শ্রীলঙ্কা সিরিজ দিয়ে নতুন নিয়ম চালু আইসিসির

এদিকে এবারের চ্যাম্পিয়নস লিগ জয়ের মাধ্যমে অনন্য এক কীর্তিতে নাম ওঠে স্প্যানিশ এই কোচের। পেপ গার্দিওলার পর দ্বিতীয় কোচ হিসেবে দুইটি ইউরোপিয়ান ট্রেবল জয়ের অনন্য রেকর্ডে নাম উঠেছে এনরিকের। এর আগে ২০১৫ সালে বার্সেলোনার হয়ে প্রথমবারের মতো ট্রেবল জিতেছিলেন লুইস এনরিকে। এবার ঠিক দশ বছর পর আবারো ইউরোপের এই শ্রেষ্ঠত্বের মুকুট পড়েছে এনরিকে ও তার দল। অন্যদিকে পেপ গার্দিওলাও প্রথমবার বার্সেলোনার অধীনেই ট্রেবল জিতে নেন। ২০০৯ সালে বার্সার হয়ে ইউরোপের বুকে ইতিহাস লেখা গার্দিওলা ২০২৩ সালে ম্যানচেস্টার সিটির হয়ে জেতেন ইউরোপীয় ট্রেবল। 

আরও খবর

একটি মন্তব্য করুন

দয়া করে আপনার মন্তব্য লিখুন
দয়া করে এখানে আপনার নাম লিখুন

সর্বশেষ খবর

জনপ্রিয় খবর