অবশেষে শেষের সুর বেজে উঠলো এক কিংবদন্তির বিদায়ঘণ্টায়। রিয়াল মাদ্রিদে দীর্ঘ ১৩ বছরের সমৃদ্ধ, সোনালি, এবং ঐতিহাসিক যাত্রা শেষে থামছেন লুকা মদ্রিচ। সেই মদ্রিচ, যিনি একসময় ছিলেন যুদ্ধবিধ্বস্ত ক্রোয়েশিয়ার এক অনিশ্চিত কিশোর— আজ তিনি বিশ্বের অন্যতম শ্রেষ্ঠ ফুটবল ক্লাবের এক অমর ইতিহাস। অবশেষে, ফুটবল বিশ্বকে জানিয়ে দিলেন, ২০২৫ সালের ক্লাব বিশ্বকাপই হবে ‘লা ব্লাঙ্কো’দের হয়ে তার শেষ ম্যাচ।
“এটা এমন এক মুহূর্ত, যা আমি কখনো চাইনি। কিন্তু ফুটবলই এমন— প্রতিটি গল্পেরই এক শুরু এবং এক শেষ থাকে”— এমন আবেগঘন বার্তায় বিদায় জানান এই মাঝমাঠের জাদুকর।

আরও পড়ুন: ডেথ ওভারে মুস্তাফিজই ডট বলের রাজা
৩৯ বছর বয়সী এই শিল্পী, যিনি প্রতিটি পাসে, প্রতিটি টার্নে এবং প্রতিটি মুভমেন্টে মাঠে রচনা করেছেন একেকটি কাব্য, বুড়ো বয়সে এসেও যিনি রচিত করেছেন নতুন ইতিহাস। সেই মদ্রিচ আগামী শনিবার ঘরের মাঠ সান্তিয়াগো বার্নাব্যুতে রিয়াল সোসিয়েদাদের বিপক্ষে নামবেন শেষবারের মতো। এরপর, ফিফা ক্লাব বিশ্বকাপে আগামী ১৮ জুন সৌদি ক্লাব আল হিলালের বিপক্ষে ম্যাচ দিয়ে শুরু হবে রিয়ালে তার মহাকাব্যিক অধ্যায়ের শেষের গান। এই টুর্নামেন্টেই শেষ বারের মতো সাদা জার্সিতে মাঠে নামবেন তিনি।
একসময়ের ‘ফ্লপ অফ দ্য সাইনিং’ লুকা মদ্রিচ, রিয়াল মাদ্রিদের ইতিহাসে সবচেয়ে বেশি শিরোপাজয়ী খেলোয়াড় হিসেবে বিদায় নিচ্ছেন। ছয়টি চ্যাম্পিয়নস লিগ, চারটি লা লিগা, ছয়টি ক্লাব বিশ্বকাপসহ মোট ২৮টি শিরোপা— সংখ্যাগুলো বিস্ময় জাগায়, কিন্তু মদ্রিচকে বোঝার জন্য শুধু সংখ্যা যথেষ্ট নয়। তাকে অনুভব করতে হয় মাঠে, তার ভেতরের শান্ত অথচ দৃঢ় নেতৃত্বে, প্রতিপক্ষের মাঝখানে নিজের জন্য জায়গা করে নেওয়া ক্ষিপ্রতায়, কিংবা এক অনিন্দ্যসুন্দর কোনো থ্রু পাসে।
আরও পড়ুন: আকবরের ব্যাটে প্রত্যাবর্তনের ঝলক

“এই ক্লাবে খেলা শুধু আমার ক্যারিয়ার নয়, আমার জীবনকেই পাল্টে দিয়েছে। রিয়াল মাদ্রিদ আমার জন্য কেবল একটি ক্লাব নয়, এটি এমন এক পরিবার, যাদের জন্য আমার প্রতিটি পদক্ষেপ তৈরি হয়েছে”— বলেন মদ্রিচ।
২০১২ সালে টটেনহ্যাম হটস্পার থেকে যোগ দেওয়ার সময় তাকে বলা হয়েছিল ‘ফ্লপ অব দ্য সিজন’। কিন্তু সময় আর সৃজনশীলতা দিয়ে নিজের জন্য গড়েছেন মরণান্তী প্রতিকূলতা পেরোনো এক অনন্য গাঁথা। আজ সেই মদ্রিচ রিয়ালের কিংবদন্তিদের তালিকায় শীর্ষ সারিতে। তিনি নিজেও বলেন, “আমি যে স্বপ্ন নিয়ে রিয়ালে এসেছিলাম, তা ছিল কেবল শুরু। এখন আমি বলতে পারি, যা ঘটেছে, তা ছিল আমার সবচেয়ে বড় স্বপ্নের চেয়েও অনেক বড়।”
রিয়াল মাদ্রিদের প্রেসিডেন্ট ফ্লোরেন্তিনো পেরেজ তার বিদায় উপলক্ষে বলেন, “লুকা মদ্রিচের বিদায়ে কেবল একজন খেলোয়াড় নয়, রিয়াল মাদ্রিদের আত্মার একটা অংশ আমাদের ছেড়ে যাচ্ছে। তিনি আমাদের কল্পনাকে বাস্তব বানিয়েছেন, শিরোপার সীমা ছুঁয়েছেন এবং মাদ্রিদের চেতনাকে এক নতুন উচ্চতায় নিয়ে গেছেন।”

গুঞ্জন আছে, যদিও লুকা মদ্রিচ আরও একবছর এই ক্লাবে থাকতে চেয়েছিলেন। তবে রিয়াল মাদ্রিদ জানিয়ে দিয়েছে, আগামী মৌসুমে তারা নতুনদের নিয়েই সামনে এগিয়ে যেতে চায়। যেখানে ক্লাবের এই সিদ্ধান্তকে সম্মানের সাথেই গ্রহণ করেছেন এই ক্রোয়েশিয়ান জাদুকর।
আরও পড়ুন: রোনালদো জুনিয়রের জোড়া গোলে চ্যাম্পিয়ন পর্তুগাল
মদ্রিচের বিদায় আরও আবেগঘন করে তুলেছে যখন দেখা যায় আরেক অদ্ভুত মিলের। একবছর আগে এই মে মাসেই রিয়াল মাদ্রিদকে বিদায় জানিয়েছিলেন এই ক্লাবেরই আরেক মধ্যমাঠের জাদুকর, মদ্রিচের দীর্ঘদিনের সঙ্গী জার্মান কিংবদন্তি টনি ক্রুস। এক দশকেরও বেশি সময় ধরে মদ্রিচ-ক্রুস জুটি রিয়ালের মাঝমাঠে এক অনন্য যুগল হয়ে খেলেছে। কে সেরা? এই প্রশ্নে তারা নিজেরাই বারবার বলেছেন— তারা একসাথে বলেই সব সুন্দর। একসাথে শুরুর গল্প যেমন ছিল, তেমনি এবার একইসাথে বিদায়ের বাঁশিও যেনো বেজে উঠলো।
এই মধ্যমাঠের জাদুকর শুধু ক্লাবেই নিজের সর্বোচ্চটুকু দিয়েছেন এমনটা না। ক্রোয়েশিয়ার মতো একটা দেশকেও তুলেছেন বিশ্বকাপের ফাইনালে। যেখানে ক্রোয়াটদের কেউ কখনো সেভাবে বড় দলই ভাবতে পারেনি, সেই দলটিকে নিয়ে পরবর্তীতে ন্যাশন্স লিগের ফাইনালেও উঠেছিলেন এই কিংবদন্তি। এছাড়া ইউরোর মঞ্চেও বারবার ক্রোয়েশিয়াকে বড় স্বপ্ন দেখাতেও শিখিয়েছেন ‘রিফিউজি’ থেকে ফুটবলের কিংবদন্তি হয়ে উঠা এই গ্রেট ফুটবলার।

এমনকি মেসি-রোনালদোর আধিপত্যে যখন ব্যালন ডি’অর জেতা ছিল এক অসম্ভব কল্পনা, তখনই সেই দুয়ার ভেঙে প্রবেশ করেছিলেন লুকা মদ্রিচ। ২০১৮ সালে ব্যালন ডি’অর জিতে বিশ্বকে দেখিয়ে দিয়েছিলেন— নাম নয়, ফুটবল মাপা হয় হৃদয়, নিষ্ঠা আর সাহস দিয়ে।
আরও পড়ুন: ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে ১২৪ রানের রেকর্ড জয় আইরিশদের
এই বিদায় কেবল একটি অধ্যায়ের সমাপ্তি নয়। এটি রিয়াল মাদ্রিদের জন্য এক যুগের অবসান। মদ্রিচ শুধু মাঠে নন, ড্রেসিংরুমেও ছিলেন একজন নেতা, একজন বড় ভাই, একজন অনুপ্রেরণা। তার বিদায়ে তৈরি হবে এক শূন্যতা, যা হয়তো কখনওই পুরোপুরি পূরণ হবে না।
কিন্তু বিদায় মানেই কি সবশেষ? ইতিহাস বলে, না। কিংবদন্তিরা চলে যান ঠিকই, কিন্তু থেকে যান স্মৃতির পাতায়, ট্রফির মঞ্চে, এবং কোটি ভক্তের হৃদয়ে।
বার্নাব্যুয়ের বাতিগুলো হয়তো আর তার জন্য জ্বলবে না, কিন্তু গ্যালারির বাঁকে এখনও কেউ হয়তো কান পাতলে শুনতে পাবে— “লুকা… লুকা…” ধ্বনি।

রিয়াল ভক্তদের এখন একটাই প্রার্থনা— আগামী ক্লাব বিশ্বকাপে বিদায়ের মঞ্চে যেন শিরোপা হাতে শেষ সংলাপ বলতে পারেন এই যোদ্ধা। বিদায় লুকা মদ্রিচ, আপনাকে মনে রাখবে এই মহাকাল।
আরও পড়ুন: রোনালদোর সঙ্গে দ্বৈরথ ফুটবলের শ্রেষ্ঠ অধ্যায়: মেসি