সব জল্পনার ইতি টেনে নতুন অধ্যায়ের শুরু হতে যাচ্ছে কার্লো আনচেলত্তির। মঞ্চ বদলাচ্ছেন, কিন্তু আলো রয়ে যাচ্ছে ঠিকই। রিয়াল মাদ্রিদকে সাফল্যে ভাসিয়ে, এবার ফুটবল ইতিহাসের আরেক মহাবৃত্তে পা রাখতে চলেছেন এই ইতালিয়ান কোচ। মে মাসের শেষেই আনচেলত্তি দায়িত্ব নিচ্ছেন ব্রাজিল জাতীয় দলের প্রধান কোচ হিসেবে।
কিছুদিন আগেই গুঞ্জন উঠেছিল, আনচেলত্তি ব্রাজিল যাচ্ছেন। কিন্তু নাটক জমে ওঠে রিয়ালের সঙ্গে চুক্তির একটি ধারা নিয়ে। প্রেসিডেন্ট ফ্লোরেন্তিনো পেরেজের আপত্তিতে থমকে যায় সবকিছু। অবশেষে সব জটিলতা কাটিয়ে চূড়ান্ত হয়েছে নতুন গন্তব্য। বিশ্বখ্যাত সাংবাদিক ফাব্রিজিও রোমানো এবং ব্রিটিশ গণমাধ্যম বিবিসি নিশ্চিত করেছে আনচেলত্তির ব্রাজিল মিশনের খবর।
আরও পড়ুন: এক সিরিজ নিয়ে নয়, লিটন করতে চান ভবিষ্যত পরিকল্পনা

জুনেই বিশ্বকাপ বাছাই পর্ব দিয়ে শুরু হবে আনচেলত্তির ব্রাজিল অধ্যায়। তার কোচিং স্টাফ ও সহকারীদের নামও ইতোমধ্যে নির্ধারিত হয়ে গেছে। ব্রাজিলের ফুটবল ফেডারেশন তাকে দলে আনতে বদ্ধপরিকর ছিল দীর্ঘদিন ধরে। আনচেলত্তির অভিজ্ঞতা, খ্যাতি ও ট্রফি-ভাণ্ডার ব্রাজিলের পরবর্তী রূপান্তরের জন্য নিঃসন্দেহে বড় প্রাপ্তি।
রিয়াল মাদ্রিদের হয়ে দুই দফায় (২০১৩–২০১৫ এবং ২০২১–২০২৫) সবমিলিয়ে ১৫টি শিরোপা জিতেছেন আনচেলত্তি। লা লিগা, চ্যাম্পিয়ন্স লিগ, ক্লাব বিশ্বকাপ— সব ট্রফিতেই ছাপ রেখে গেছেন। শুধু সাফল্য নয়, সান্তিয়াগো বার্নাব্যুতে তার উপস্থিতি হয়ে উঠেছিল একটি আবেগের নাম, একটি নীরব বন্ধন।
এই মৌসুম শেষে রিয়ালের শেষ ম্যাচ হবে সোসিয়েদাদের বিপক্ষে। এরপরই আনুষ্ঠানিকভাবে বিদায় নেবেন এই কিংবদন্তি। ক্লাব তাকে নিয়ে একটি বিশেষ বিদায়ী আয়োজন করবে, যেখানে হয়তো চোখের কোণে জল লুকিয়ে রাখবেন অনেকেই।
আরও পড়ুন: বিসিবি চাইলে আমরা অবশ্যই পাকিস্তানে খেলতে যাব: লিটন

তবে আনচেলত্তিকে বলা হয় ডাগআউটে দাঁড়ানো ‘শান্ত জাদুকর’। ম্যাচের গুরুত্বপূর্ণ মুহুর্তেও মেজাজ ঠান্ডা রাখা এই কোচের অর্জনেরও তো শেষ নেই। ইউরোপীয় ক্লাব ফুটবলে ট্রফির পর ট্রফি জিতে নিজেকে নিয়ে গেছেন অনন্য এক উচ্চতায়। এবার সেই অনন্য অভিজ্ঞতাকে জাতীয় দলের গণ্ডিতে কাজে লাগাতেই আনচেলত্তিকে নিজেদের দলে ভিড়িয়েছে পাঁচবারের বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন ব্রাজিল। আর এই দায়িত্বের বিনিময়ে যা পাচ্ছেন আনচেলত্তি, তা জাতীয় দলের ইতিহাসে কোচদের মধ্যে অন্যতম আর্থিক চুক্তি হিসেবেই বিবেচিত হচ্ছে।
জনপ্রিয় ওয়েবসাইট ইএসপিএন থেকে গ্লোবোর প্রকাশিত খবরে জানা গেছে, আনচেলত্তিকে প্রতি সপ্তাহে দেওয়া হবে ১ লাখ ৭৭ হাজার ৫০০ ইউরো, যার মাসিক বেতন হবে ৮ লাখ ৫০ হাজার মার্কিন ডলার, অর্থাৎ বছরে ১ কোটি ডলার— যা ব্রাজিল ফুটবল ইতিহাসে কোচ হিসেবে সর্বোচ্চ পারিশ্রমিক।

বাংলাদেশি মুদ্রায় আনচেলত্তির মাসিক আয় দাঁড়ায় ১০ কোটিরও বেশি। আর বাৎসরিক হিসাবে সেটি বাংলা টাকায় ১২১ কোটির আশেপাশে। শুধু তাই নয়, যদি তিনি ২০২৬ বিশ্বকাপে ব্রাজিলকে ষষ্ঠ শিরোপা এনে দিতে পারেন, তাহলে পাবেন আরও ৫০ লাখ ইউরো, যা প্রায় ৫৫ লাখ ডলার।
সব মিলিয়ে আনচেলত্তির নতুন চুক্তিতে জানান দিচ্ছে, বর্তমানে জাতীয় দলের কোচ হিসেবে তিনিই হতে যাচ্ছেন সবচেয়ে বেশি বেতনভুক্ত কোচ। তার পরেই আছেন ইংল্যান্ডের বর্তমান কোচ টমাস টুচেল।
এছাড়া আনচেলত্তির জন্য রিও ডি জেনেইরোর সেরা এলাকায় বিলাসবহুল আবাসনের ব্যবস্থা করছে সিবিএফ। তার পরিবার ইউরোপে অবস্থান করায় যাতায়াতের জন্য থাকবে প্রাইভেট জেটের সুবিধা, মিলবে আন্তর্জাতিক স্বাস্থ্য বীমা ও জীবন বীমা। এইসব সুবিধা দেখেই বোঝা যায়, ব্রাজিল কতটা গুরুত্ব দিয়ে ভাবছে এই ইতালিয়ান কোচকে ঘিরে।
আরও পড়ুন: ১৭ মে থেকে ফের শুরু আইপিএল, ফাইনাল ৩ জুন

আনচেলত্তিকে নিয়ে ব্রাজিলের স্বপ্ন কেবল বিশ্বকাপ জয় নয়, বরং নতুন একটি ধারার সূচনা। টেকনিক্যাল ফুটবলের সঙ্গে ইউরোপিয়ান কৌশলের সঠিক মিশেলে যেন আবারও গড়ে ওঠে সেই ‘সেলেসাও’ যা ব্রাজিলকে এনে দিতে পারে তাদের কাঙ্খিত হেক্সা।
ব্রাজিলের কোচ হিসেবে আনচেলত্তির অধ্যায় শুরু হবে এক নতুন কৌতূহল নিয়ে। জাতীয় দলের দায়িত্ব ক্লাবের চেয়ে ভিন্ন, সেখানে সময় কম, পরীক্ষা বেশি। তবে যার ঝুলিতে আছে ইউরোপের পাঁচটি শীর্ষ লিগ জয়ের কীর্তি, তাকে নিয়ে আশাবাদী হওয়ার যথেষ্ট কারণই আছে।
এছাড়াও ইউরোপিয়ান মিডিয়া দাবী করছে, এরই মধ্যে আনচেলত্তি তার কাজ শুরু করে দিয়েছে। সাবেক রিয়াল মাদ্রিদ তারকা ফুটবলার ক্যাসেমিরো, যিনি বর্তমানে ইংলিশ ক্লাব ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডের হয়ে খেলছেন। তাকে আবারও ব্রাজিল জাতীয় দলে ফেরাতে চাচ্ছেন আনচেলত্তি। এই ডিফেন্সিভ মিডফিল্ডারকে সাথে নিয়ে সেলেসাওদের মাঝমাঠ আরও সুরক্ষিত করতে চাচ্ছেন তিনি। এছাড়া আনচেলত্তি চাচ্ছেন নেইমারকেও। যদিও ইনজুরি জনিত কারণে আপাতত মাঠে বাইরে এই পোস্টার বয়। তবে ২৬ বিশ্বকাপকে ঘিরে এরই মধ্যে ব্রাজিলকে নিয়ে পরিকল্পনা আঁটছেন তিনি। যেখানে নেইমার-ক্যাসেমিরোর মতো অভিজ্ঞ ফুটবলার থেকে বর্তমানের ভিনিসিয়াস-রদ্রিগো ও রাফিনহারাও রয়েছেন আনচেলত্তির পরিকল্পনায়।

আনচেলত্তি যখন বার্নাব্যু ছাড়বেন, তার পেছনে থাকবে এক গৌরবোজ্জ্বল অধ্যায়। আর সামনে, ফুটবল বিশ্বের সবচেয়ে ঐতিহ্যবাহী জার্সির পাশে নিজের নাম লেখার সুযোগ। ব্রাজিলের ফুটবল ইতিহাসেই সর্বোচ্চ বেতন দেওয়া হবে এই ইতালিয়ান কোচকে। সেলেসাওদের চাওয়া শুধু একটাই, তাদের হারানো জৌলুস ফিরিয়ে আনা। শেষ কয়েকবছরে যেভাবে ব্রাজিল প্রতিনিয়ত পরাস্ত হয়েছে তা থেকে কেবল আনচেলত্তিই এই দলকে নিয়ে ঘুরে দাঁড়াতে পারবে, এমনটাই বিশ্বাস সবার।
আরও পড়ুন: বিদেশি ক্রিকেটারের জন্য পিএসএলে হতে পারে বিকল্প ড্রাফট
আর গৌরবের ‘ক্লাব ঐতিহ্য’ কে পিছনে ফেলে আপাতত আনচেলত্তির লক্ষ্য জাতীয় দলের হয়েও নিজেকে সাফল্যের শীর্ষে উঠিয়ে নেওয়া। এখন দেখার পালা, এত টাকায় আনচেলত্তিকে এনে ব্রাজিল তাদের ৬ষ্ঠ বিশ্বকাপ জিততে পারে কিনা।