বৃহস্পতিবার, জুন ২৬, ২০২৫
সামি'স কর্নার

বার্নাব্যুতে চোখ ভেজালেন ক্রুস-মদ্রিচ, বিদায় নিয়েছেন আনচেলত্তিও

সান্তিয়াগো বার্নাব্যুর রাতটা ছিল স্মৃতি, আবেগ আর বিদায়ের। রিয়াল মাদ্রিদের ইতিহাসে এক অনন্য অধ্যায়ের শেষ দৃশ্য যেন মঞ্চস্থ হলো শনিবার (২৪ মে) রাতে। এক যুগেরও বেশি সময় ধরে যিনি এই ক্লাবের মাঝমাঠে রাজত্ব করেছেন, সেই লুকা মদ্রিচ শেষবারের মতো বার্নাব্যুর আলো ছুঁয়ে বিদায় জানালেন। আর সেই বিদায়ের আবহেই রিয়াল ছাড়ছেন ক্লাবটির ইতিহাসের সবচেয়ে সফল কোচ, কার্লো আনচেলত্তি। দুই কিংবদন্তির এমন বিদায়ে গ্যালারি যেন এক বিশাল হৃদয়ে পরিণত হয়েছিল, যার প্রতিটি কণায় জমে ছিল ভালোবাসা, কৃতজ্ঞতা আর না বলা শতশত স্মৃতি।

একই দিনে, অনেকটাই নীরবে কিন্তু শ্রদ্ধার সাথে বিদায় নিয়েছেন আরেক রিয়াল কিংবদন্তি, লুকাস ভাস্কুয়েজ। রিয়ালের একাডেমির এই বর্ষীয়ান ফুটবলারও ঘরের মাঠে শেষবারের মতো নেমেছিলেন বার্নাব্যুতে। সারাজীবন আড়ালে থেকে হলেও ভাস্কুয়েজ ছিলেন দলের অবিচ্ছেদ্য অংশ।

পাঁচবারের চ্যাম্পিয়ন্স লিগ জয়, সেই ঐতিহাসিক হ্যাটট্রিক ইউসিএল শিরোপার সময় জিদানের অধীনে সর্বোচ্চ ৪০টি অ্যাসিস্ট তার নামে রয়েছে। রিয়াল মাদ্রিদের জন্য লুকাস ভাস্কুয়েজও একজন কিংবদন্তির মাপকাঠিতে কম নয়। আগামী জুনে, মদ্রিচের মতো, ভাস্কুয়েজও শেষবারের মতো ক্লাব বিশ্বকাপে রিয়াল জার্সি গায়ে জড়িয়ে মাঠে নামবেন, কিন্তু ঘরের মাঠে এটাই ছিল তার শেষ গানের সুর।

আরও পড়ুন: রোনালদো জুনিয়রের জোড়া গোলে চ্যাম্পিয়ন পর্তুগাল

৩৮ বছর বয়সী ক্রোয়াট মিডফিল্ডার লুকা মদ্রিচ বার্নাব্যুর সবুজ ঘাসে পা রেখেছিলেন অনেকটা নীরবতায়, কিন্তু বিদায়ের সময় প্রতিটি ধাপে ধ্বনিত হচ্ছিল করতালির গর্জন। ম্যাচের শুরু থেকে শেষ, প্রতিটি ওয়ার্মআপ, প্রতিটি বল ছোঁয়া— সবকিছুই যেন ভেসে যাচ্ছিল এক আবেগঘন মুহূর্তে। আর যখন ৮৬তম মিনিটে বদলি হয়ে মাঠ ছাড়েন, তখন গ্যালারিতে নেমে আসে নীরব শ্রদ্ধা ও ভেজা চোখের সম্মিলিত প্রণতি। স্ট্যান্ডে বসে থাকা টনি ক্রুস, যিনি নিজেও এক বছর আগে বার্নাব্যুতে বিদায় নিয়েছেন, এবার পাশে দাঁড়ালেন তাঁর দীর্ঘদিনের সঙ্গীর শেষ অভিযানে। বার্নাব্যুতে সেই এই জুটির আলিঙ্গনে কেঁপে উঠেছিল পুরো স্টেডিয়াম।

শেষ বাঁশি বাজার পরও থামেনি আবেগের ঢল। মাঠজুড়ে তখন শুধু মদ্রিচ, শুধু স্মৃতি। রিয়াল মাদ্রিদ ও রিয়াল সোসিয়েদাদ—উভয় দলের খেলোয়াড়রা তৈরি করেন গার্ড অব অনার, যেন সম্মান জানান এক মহান শিল্পীকে। কোচ আনচেলত্তিসহ সতীর্থদের আলিঙ্গনে মদ্রিচের চোখে ফুটে উঠেছিল সেই সম্পর্কের গভীরতা, যা কেবল ম্যাচ জয়-পরাজয়ের গণ্ডি ছাড়িয়ে যায়।

আরও পড়ুন: রিয়ালের ইতিহাসের পাতায় ইতি টানছেন লুকা মদ্রিচ

তবে মদ্রিচই একমাত্র নন, যাঁর জন্য ছিল বিদায়ের এই আবেগ। বার্নাব্যুর সেই রাতের আরেক নায়ক কার্লো আনচেলত্তি— যিনি জানিয়ে দিলেন, আপাতত আর রিয়ালের ডাগআউটে দেখা যাবে না তাঁকে। এবার তাঁর গন্তব্য ব্রাজিল, নতুন মিশনে, সেলেসাওদের স্বপ্নের হেক্সা জয়ের পথে। ছয় বছরের রিয়াল অধ্যায়ে জিতেছেন ১৫টি শিরোপা— তিনটি চ্যাম্পিয়নস লিগ, দুটি লা লিগা, দুটি কোপা দেল রে, তিনটি উয়েফা সুপার কাপ, দুটি স্প্যানিশ সুপার কাপ, দুটি ক্লাব বিশ্বকাপ এবং একটি ইন্টারকন্টিনেন্টাল কাপ। তবে শিরোপার সংখ্যার থেকেও বড় হয়ে আছে তাঁর রেখে যাওয়া ছাপ— খেলোয়াড়দের সঙ্গে সম্পর্ক, মাঠের পাশে সংযত অভিব্যক্তি আর ড্রেসিংরুমে এক পিতৃতুল্য উপস্থিতি।

৬৫ বছর বয়সী আনচেলত্তির কণ্ঠে ছিল শ্রদ্ধা ও ভালোবাসার মিশেল। রিয়াল মাদ্রিদ টিভিকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, “আমি কাঁদছি, এটা স্বাভাবিক। কারণ এটি শুধু একটি ক্লাব নয়, এটি ছিল আমার দ্বিতীয় পরিবার। প্রতিটি মুহূর্ত আমি হৃদয়ে ধারণ করে যাব। আজ আমি বলতে পারি, ইতিহাসের অংশ হতে পেরেছি।” তাঁর বিদায় যেন আরও স্থায়ী, আরও নিশ্চিত। তাঁর স্থলাভিষিক্ত হিসেবে উঠে আসছে সাবেক রিয়াল মিডফিল্ডার ও বায়ার লেভারকুসেন কোচ শাবি আলোনসোর নাম।

মাঠের ধারে অপেক্ষা করছিল মদ্রিচের পরিবার— স্ত্রী ও তিন সন্তান। তাঁদের চোখেও ছিল গর্ব, ভালোবাসা আর কৃতজ্ঞতা। দীর্ঘ এক যুগের স্মৃতি যেন একসঙ্গে ভেসে উঠছিল সেই সন্ধ্যায়। বরফশীতল, স্থিরচিন্তাশীল মদ্রিচ নিজের চোখেও ধরে রাখতে পারেননি অশ্রু। সেই ফুটবলার, যিনি কখনো মাতেননি বাহ্যিক উল্লাসে, বিদায়ের রাতে যেন বললেন না বলা বহু কথা। দর্শকদের উদ্দেশে তাঁর বার্তা ছিল সাদামাটা, অথচ হৃদয়ভেদী—“কেঁদো না কারণ এটি শেষ হয়েছে, বরং হাসো কারণ এটা ঘটেছিল।”

আরও পড়ুন: রোনালদোর সঙ্গে দ্বৈরথ ফুটবলের শ্রেষ্ঠ অধ্যায়: মেসি

রিয়াল মাদ্রিদের মধ্যমাঠ মানেই ছিল মদ্রিচ— তাঁর নিঃশব্দ নেতৃত্ব, বলের প্রতিটি স্পর্শে জাদু, আর চোখে না পড়া অবদান। কাসেমিরো, ক্রুস আর মদ্রিচ— এই ত্রয়ীর যুগ শেষ হয়েছে অনেকটা আগেই, তবে মদ্রিচ ছিলেন আইকনিক এই ত্রয়ীর শেষ প্রহরী। তাঁর বিদায় মানে শুধু একজন খেলোয়াড়ের না থাকা নয়, একটি প্রজন্মের নতুন করে গড়া উঠা। মাঠে নেতৃত্বদান, ড্রেসিংরুমে স্থিরতা এবং মাঠের বাইরেও অতুলনীয় মানবিকতা— সবকিছুর এক অনবদ্য মিশ্রণ ছিলেন তিনি।

শনিবারের এই ম্যাচে এমবাপের জোড়া গোলে ২-০ গোলে রিয়াল সোসিয়েদাদের হারানো হয়তো অনেকে মনে রাখবে না, কিন্তু বার্নাব্যু যে রাতটিকে রাঙিয়ে তুলেছিল ইতিহাসের ক্যানভাসে, তা ভুলবে না কেউ। আনচেলত্তি জানেন, তাঁর বিদায় মানে দায়িত্ব তুলে দেওয়া নতুনদের হাতে। আর মদ্রিচ? তিনিও জানেন, কোনো জাদু চিরকাল স্থায়ী হয় না। তবে তাঁদের রেখে যাওয়া ঐতিহ্য, ভালোবাসা ও সাফল্যের মানচিত্র নতুনদের পথ দেখাবে বারবার।

শেষ মুহূর্তের সেই চিত্রগুলো— মদ্রিচের চোখের জল, ক্রুসের আলিঙ্গন, সতীর্থদের শ্রদ্ধা, কোচের বিদায়বাক্য আর দর্শকের কান্না— সবকিছু মিলে তৈরি করে দিল এক চিরস্মরণীয় অধ্যায়। এক যুগ, আর কয়েকজন কিংবদন্তি আর এক ভালোবাসার দল— রিয়াল মাদ্রিদ। এই রাতের পর সেই দলটি আর আগের মতো থাকবে না, কিন্তু তাঁদের রেখে যাওয়া আলো ঠিকই পথ দেখাবে ভবিষ্যতের রিয়ালকে।

আরও পড়ুন: শেষ মুহূর্তের গোলে প্রিমিয়ার লিগে ফেরার স্বপ্নভঙ্গ হামজার

আরও খবর

একটি মন্তব্য করুন

দয়া করে আপনার মন্তব্য লিখুন
দয়া করে এখানে আপনার নাম লিখুন

সর্বশেষ খবর

জনপ্রিয় খবর