১৩টি ক্লাবে নাম লিখিয়েছেন। অথচ খেলেননি একটি ম্যাচও! প্রতারণাকে শিল্পের পর্যায়ে নিয়ে গিয়েছিলেন। উইকিপিডিয়ায় তাই তাকে আখ্যায়িত করা হয় কন আর্টিস্ট হিসেবে। কার্লোস কাইজার— নামটা উচ্চারণ করলেই ফুটবলপ্রেমীদের মনে ভেসে ওঠে হাস্যরসের এক প্রতারণার গল্প। এক ফুটবলার— যে ফুটবল খেলতেই জানত না!
ফুটবল ইতিহাসে প্রতিভা, কীর্তি আর গৌরবের গল্প তো অজস্র। কিন্তু ইতিহাসের পেছনের পাতায় কোথাও কোথাও লেখা থাকে এমন কিছু চরিত্রের গল্প— যাদের জীবন রূপকথার মতো, অথচ সেই রূপকথায় নেই জয়ধ্বনি, নেই গোলের ঝলকানি।
ব্রাজিলের রিও ডি জেনেইরোর অলি-গলিতে বেড়ে ওঠা এক যুবক। স্বপ্ন ছিল ফুটবল তারকাদের মতো জীবনযাপন। কিন্তু জানত— ফুটবলের জাদুকরী পায়ের কাজ তার দ্বারা সম্ভব নয়। সেই অক্ষমতা ঢাকতেই সে বেছে নিল অভিনয়, চালাকি আর প্রতারণার রাস্তা।

নিজেকে তৈরি করল এক আদর্শ ফুটবলারের চেহারায়। শারীরিক গঠন নিখুঁত। মাঠে না খেললেও বাইরে থেকে দেখলে তাকে চিনতেই পারত না কেউ— যে সে বল ধরতে জানে না।
কার্লোস কাইজার জানত, ব্রাজিলের ফুটবল জগতে টিকে থাকতে গেলে প্রতিভা নয়, দরকার প্রভাবশালী বন্ধু। জিকো, রোনালদোদের মতো কিংবদন্তিদের সঙ্গে বন্ধুত্ব করল সে। তারাই তাকে পরিচয় করিয়ে দিত বড় বড় ক্লাবের সঙ্গে।
আরও পড়ুন: অবশেষে বাটলারের ক্যাম্পে যোগ দিলেন ‘বিদ্রোহী’ ফুটবলাররা
ক্লাবে ঢুকেই শুরু হতো তার অভিনয়। কখনও ইনজুরি নাটক, কখনও বানানো ফোনকল— যেন ইউরোপের বড় ক্লাবগুলো তার জন্য লাইন ধরে আছে। ম্যাচ এলেই মাংসপেশির টান, হাঁটুর সমস্যা কিংবা মাঠে ঝামেলা লাগিয়ে নিজের অনুপস্থিতি নিশ্চিত করা ছিল তার নিয়মিত কৌশল।
কাইজার সাংবাদিকদের দিয়েও নিজের প্রচারণা করাতো। পত্রিকায় ভুয়া খবর ছাপাতো— ‘পিএসজি তাকে চাইছে’, ‘ইউরোপের বড় ক্লাব আগ্রহী’— এসব কল্পিত খবর ক্লাবের কর্তাদের চোখে পড়লে তার মূল্য আরও বেড়ে যেত।

বছরের পর বছর— এক ক্লাব থেকে আরেক ক্লাবে— একই স্ক্রিপ্টে চলেছে তার অভিনয়। অথচ সব জানার পরেও ক্লাবগুলো তাকে ভালোবাসত, কারণ সে ছিল জীবনযাপন আর সম্পর্কের এক অনন্য চরিত্র।
কার্লোস কাইজারের জীবন এক বিচিত্র বাস্তবতা। সে খেলেছে বোটাফোগো, ফ্লুমিনেন্সে, ফ্ল্যামেঙ্গো, ভাস্কো দা গামার মতো নামী ক্লাবে। অথচ গুনে গুনে তার মাঠের উপস্থিতি শূন্যের কোঠায়। গোলসংখ্যাও শূন্য।
তবুও সে বেঁচে ছিল এক ফুটবল তারকার মতো— পার্টি, বিলাসিতা আর প্রশংসায়।
আরও পড়ুন: কনকাশনের থাবায় ২৭ বছর বয়সেই থামলেন পুকোভস্কি
কার্লোস কাইজারের এই অবিশ্বাস্য জীবনের গল্প এতটাই বিখ্যাত যে, তার জীবনভিত্তিক একটি সিনেমাও তৈরি হয়েছে— “Kaiser: The Greatest Footballer Never to Play Football”।
২০১৮ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত এই ডকুমেন্টারি ফিল্ম ফুটবলবিশ্বের সামনে তুলে ধরে কাইজারের রহস্যময় জীবন। কীভাবে একজন মানুষ প্রতারণা, অভিনয় আর মিথ্যাকে শিল্পের পর্যায়ে নিয়ে গিয়ে ফুটবলের সবচেয়ে আলোচিত চরিত্র হয়ে উঠতে পারে— এই সিনেমা যেন তারই দলিল।

কার্লোস কাইজার নিজে একবার বলেছিলেন—
“আমি কাউকে কষ্ট দিইনি। ক্লাব আমাকে ভালোবেসে নিয়েছে। আমি শুধু সেই ভালোবাসা ফিরিয়ে দিয়েছি আমার অভিনয় দিয়ে।”
তার জীবন আমাদের শেখায়— জীবনে টিকে থাকার রাস্তা একেকজনের একেক রকম। কেউ প্রতিভা দিয়ে জয় করে মাঠ, কেউ চালাকি দিয়ে জয় করে জীবন।
কাইজারের জীবন হয়তো ফুটবলের ইতিহাসে অদ্ভুত এক ব্যতিক্রম। কিন্তু তাতেই তো সে অমর। গোল না করেও, খেলা না জিতেও— যে মানুষটি নিজের জীবনের গল্পকে সিনেমার পর্দায় নিয়ে যেতে পেরেছে— সে তো সত্যিই এক অনন্য কিংবদন্তি।
তবুও সিনিয়র ক্যারিয়ারে ১৩টি ক্লাবে নাম লিখিয়েও কোনো ম্যাচ না খেলা, প্রতারণাকে শিল্পের পর্যায়ে নিয়ে যাওয়া এই কন আর্টিস্ট দিনশেষে পরিচিতি পেয়েছেন, দ্য গ্রেটেস্ট কনম্যান অব ফুটবল। প্রতারণা করেও যিনি পেয়েছেন সাফল্য, যার জনপ্রিয়তা পৌছে গিয়েছিলো সর্বত্রই।