বৃহস্পতিবার, জুন ২৬, ২০২৫
সামি'স কর্নার

ক্যান্সার জয় করে মাঠের নায়ক ফ্রানচেস্কো আচেরবি

আবারও মুখ থুবড়ে পড়লো বার্সেলোনা। হলো না কামব্যাক, হলো না রুপকথা লেখা। সেই পুরোনো গানটা এবার আর বাজল না—“মেস কুই উন ক্লাব”। চ্যাম্পিয়ন্স লিগের সেমিফাইনাল পর্যন্ত দুর্দান্তভাবে এগিয়ে আসা বার্সেলোনাকে থামিয়ে দিল এক অপ্রত্যাশিত গল্প। অতিরিক্ত মিনিটের এক গোল, আর তার পেছনে লুকিয়ে থাকা জীবনের অদেখা এক যুদ্ধ। যার নাম—ফ্রানচেস্কো আচেরবি কাভালিয়ের।

বার্সা ভক্তরা যখন স্বপ্ন দেখছিল, এক দশকের খরা শেষে ফাইনালে ফিরে যাবে দলটি, তখন আচেরবি হয়তো প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন এক শেষ আঘাতের। ম্যাচের যোগ করা সময়, একেবারে ক্লান্ত শরীর, হাল ছাড়ার উপক্রম, তখনই আচেরবির সেই ফিনিশিং। পুরো সান সিরো যেন থমকে গিয়েছিল এক সেকেন্ডের জন্য। তারপরই সেই ইতিহাস— আচেরবির গোলে স্কোরলাইন তখন ৩-৩। দুই লেগ মিলিয়ে যা ৬-৬। এরপর অতিরিক্ত সময়ে গিয়ে ফ্রাত্তেসির গোলে ম্যাচ জেতে ইন্টার মিলান, স্কোরলাইন দাঁড়ায় ৭-৬।

আরও পড়ুন: বাংলাদেশে আসতে চান কুইন সুলিভান

তবে এই স্কোর বা এই জয়ই হয়তো সবটা নয়। এর চেয়েও বড় হয়ে দাঁড়িয়েছে আচেরবির গল্প। কারণ এই গোল এসেছে শুধু কোনো প্রতিযোগিতা জেতার জন্য নয়, এসেছে বেঁচে থাকার লড়াইয়ের পরিণতি হিসেবে।

২০১৩ সালে আচেরবির শরীরে ধরা পড়ে টেস্টিকুলার ক্যান্সার। সে এক যুদ্ধ, যেখানে প্রতিদিন ক্যানসারের সঙ্গে লড়াই করতে হয়েছে। প্রথম দফায় জিতে গেলেও কয়েক মাসের মধ্যেই আবার ফিরে আসে রোগ।

চিকিৎসার ধাপে ধাপে নিষিদ্ধ ড্রাগ ধরা পড়ে তার রক্তে, নিষিদ্ধ হন খেলা থেকে। সেই সময়টা আচেরবির জীবনের সবচেয়ে অন্ধকার অধ্যায়। বাবাকে হারান, মায়ের মুখে কষ্টের ছাপ দেখতে দেখতে আচেরবি নিজের জীবনের মানেই হারিয়ে ফেলেন।

তিনি ডুবে যান অ্যালকোহলে, পার্টিতে, অনিয়মে। বন্ধ হয়ে যায় অনুশীলন। প্রতিদিন সকালে ঘুম ভাঙে এক ক্লান্ত বিষণ্নতায়। কিন্তু একদিন আচেরবি নিজেকেই প্রশ্ন করেছিলেন— “দ্বিতীয়বার জীবন পেয়েছি, এখন যদি এই জীবনকেও নষ্ট করি, তাহলে তো ক্যান্সারের কাছেই হেরে গেলাম!”

আরও পড়ুন: রোনালদোর ছেলের গায়ে উঠছে পর্তুগালের জার্সি

সেই প্রশ্নই যেনো আচেরবির জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দেয়।

তিনি বদলে দেন নিজের খাদ্য তালিকা, বদলে ফেলেন রুটিন, বদলে ফেলেন মানসিকতা। প্রতিটি অনুশীলনকে নেন নতুন জীবন পাওয়ার প্রতীক হিসেবে। সে সময় আচেরবি একটানা ১৪৯টি সিরি আ ম্যাচ খেলেন—নেই কোন ইনজুরি, নেই কোনো নিষেধাজ্ঞাও। এক কথায় তিনি হয়ে ওঠেন “ দ্যা আয়রনম্যান”।

ইতালির বহু ক্লাব ঘুরে ইন্টার মিলানে যখন এসেছিলেন, বয়স যখন ৩৫ ছুঁইছুঁই। অনেকেই ভেবেছিল, হয়তো ক্যারিয়ারের শেষের দিকের একটু বিশ্রাম নিতে এসেছেন। কিন্তু না, আচেরবি তো সেই মানুষ, যিনি হার মানা শিখেননি। ক্লাবের হয়ে ইতালি ঘরোয়া সব শিরোপা জিতলেও ইউরোপিয়ান মঞ্চে ছিল না কোনো গোল। চ্যাম্পিয়ন্স লিগে খেলা ৬৫টি ম্যাচে শূন্য গোল ছিল তার নামের পাশে।

আর এবার? ৬৬তম ম্যাচে, জীবনের মতোই নাটকীয় এক মুহূর্তে, আচেরবির নিখুঁত ফিনিশিংয়ে বল ঠাঁই নেয় বার্সেলোনার জালে। সেই গোল যেন তার জীবনের সব লড়াই, সব ব্যথা, সব ঘামকে এক মুহূর্তে একত্রিত করে ঘোষণা দেয়— “আমি এখনো আছি। এখনো লড়ে যাই। এবং এখনো জিতি।”

তবে এখানেই শেষ নয়। আচেরবির জীবনে আরেকটি বড় অধ্যায় হলো তার সম্পর্ক ছোট্ট ক্যানসার আক্রান্ত শিশু এলিয়া’র সঙ্গে। আচেরবির প্রোফাইল পিকচারে যার ছবি ছিল। আচেরবি তাকে ডাকতেন “লিওন” বা সিংহ। সেই শিশুটি মারা গেলে আচেরবি নিজের শরীরে ট্যাটু করান “Leone” শব্দটি। আর নিজেকেই ডাকতে শুরু করেন “লেয়োনে”— একজন লড়াকু সিংহ।

সেই লড়াকু আচেরবিই গত রাতে গর্জে উঠেছিলেন সান সিরোর গ্যালারিতে। তার চোখে জল, কিন্তু মুখে জয়ের দৃপ্ত হাসি। ম্যাচশেষে তিনি বলেছিলেন, “আমি হয়তো সেরা ডিফেন্ডার নই। কিন্তু আমি জানি কীভাবে জীবনকে ভালোবাসতে হয়। আমি জানি, যখন সবাই ভাবে ‘খেলা শেষ’, তখনও শুরু হতে পারে নতুন গল্প।”

আরও পড়ুন: সেমিতেই বিদায়, ইন্টার পাস হলো না বার্সার

একদিকে বার্সেলোনার কান্না, হতাশা, চুপচাপ ফিরে যাওয়া— সব যেন ফুটবল নামক নাটকের বিপরীত প্রান্ত। এই দলে কত আশার তরুণ! ইয়ামাল, গার্সিয়া, অলমো কিংবা রাফিনহা। তাদের চোখে ছিল ফাইনালের স্বপ্ন, কোচ হ্যান্সি ফ্লিকের কৌশল ছিল পরীক্ষিত। কিন্তু আচেরবির এক গোল সেই সব স্বপ্নকে ঠেলে দিল অতল গহ্বরে।

এই হার হয়তো বার্সেলোনার ইতিহাসে আরেকটি “বেদনাদায়ক রাত” হিসেবেই লেখা থাকবে। কিন্তু ইন্টার মিলানের, এবং আচেরবির কাছে— এই জয় শুধু একটি গোলের নয়, এটি একটি জীবনের জয়।

৩৭ বছর বয়সী একজন ক্যানসার জয়ী, যিনি মৃত্যুকে দু’বার হারিয়েছেন, চোখের সামনে বাবার মৃত্যু দেখেছেন। মদ্যপানে ডুবে জীবনটাই শেষ করে দিতে চেয়েছিলেন। সেই আচেরবির গোলেই হারলো ইউরোপের অন্যতম শক্তিশালী ক্লাব—এটাই তো রুপকথা। এটাই তো ‘ফুটবল’। যেখানে গোলের সংখ্যা নয়, বরং গল্পটাই হয়ে ওঠে সবকিছুর চেয়ে বড়।

ফাইনালে এখন ইন্টার। প্রতিপক্ষ হয়তো আর্তেতার আর্সেনাল কিংবা লুইস এনরিকের পিএসজি। কিন্তু ফ্রানচেস্কো আচেরবির গল্প যেদিন লেখা হবে, সেখানে প্রতিপক্ষ নয়, থাকবে শুধু এক শব্দ— “অদম্যতা”।

ফ্রানচেস্কো আচেরবি— একজন ডিফেন্ডার, একজন যোদ্ধা, বেঁচে ফেরার এক গল্প। একজন মানুষ, যিনি বুঝিয়ে দিলেন, জীবনের শেষ বাঁশি না বাজা পর্যন্ত হার মানা উচিত নয়।

২০২৩ সালে ইন্টার মিলানের হয়ে চ্যাম্পিয়ন্স লিগের ফাইনালেও তিনি ছিলেন অদম্য। প্রতিপক্ষের দুর্দান্ত ফরোয়ার্ড আর্লিং হালান্ডকে আঁটকে দিলেও শেষ পর্যন্ত সেবার ম্যাচ জিতেছিল পেপ গার্দিওয়ালার ম্যানচেস্টার সিটিই।

এবার দেখা পালা, দেশের হয়ে ইউরো চ্যাম্পিয়নশিপ জয়ী আচেরবি কী এবার পারবেন ক্লাবেরও নায়ক হতে? যদিও তিনি চাইবেন সেমিফাইনাল টা যেভাবে শেষ করেছেন সেভাবেই ক্যারিয়ারের শেষটা টানতে। ফুটবল ভক্তরাও অপেক্ষায়, আরও একবার ফ্রানচেস্কো আচেরবির বীরত্ব দেখার।

আরও খবর

একটি মন্তব্য করুন

দয়া করে আপনার মন্তব্য লিখুন
দয়া করে এখানে আপনার নাম লিখুন

সর্বশেষ খবর

জনপ্রিয় খবর