অ্যানফিল্ডের আকাশে যখন লাল ঝড় বইছিল, লিভারপুল তখন লিখছিল নতুন ইতিহাস। মাঠের প্রতিটি পাশ থেকে ধ্বনিত হচ্ছিল ‘ইউ উইল নেভার ওয়াক অ্যালোন’-এর অমর সুর। আর সেই গর্জন, আবেগ আর উল্লাসে কেবল হৃদয় নয়— কেঁপে উঠেছিল অ্যানফিল্ডের মাটিও। গোলের প্রতিটি মুহূর্তে দর্শকদের প্রতিক্রিয়া এতটাই তীব্র ছিল যে, বিজ্ঞানীরা সেদিন অ্যানফিল্ডে রেকর্ড করেছেন একাধিক ভূকম্পন! হ্যাঁ, শাব্দিক অর্থেই— এই উৎসবে ধরা পড়েছে ১.৭৪ মাত্রার মানবসৃষ্ট ভূমিকম্প।
২৭ এপ্রিল, ইংল্যান্ডের ঐতিহাসিক ক্লাবটি যখন টটেনহ্যামকে ৫-১ গোলে উড়িয়ে দিয়ে ২০তম শীর্ষ লিগ শিরোপা নিশ্চিত করে, তখন তা শুধু একটি ম্যাচজয় ছিল না— ছিল অপেক্ষার, আবেগের, ইতিহাসের, আর প্রজন্ম ধরে বয়ে চলা ভালোবাসার বিস্ফোরণ। আর ম্যাচে লিভারপুলের প্রতিটি গোলের পর যে শব্দতরঙ্গ তৈরি হয়েছিল, তা ধরা পড়ে ইউনিভার্সিটি অব লিভারপুলের ভূবিজ্ঞান বিভাগের গবেষকদের স্থাপন করা অত্যাধুনিক সিসমিক ডিভাইসে।
আরও পড়ুন: জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে স্টোকসের নেতৃত্বে শক্তিশালী দল ইংল্যান্ডের

ম্যাচের সবচেয়ে শক্তিশালী কম্পন অনুভূত হয় ২৪তম মিনিটে, যখন আর্জেন্টাইন মিডফিল্ডার ম্যাক অ্যালিস্টার দুর্দান্ত এক গোল করে লিভারপুলকে ২-১ ব্যবধানে এগিয়ে দেন। রিখটার স্কেলে এই কম্পনের মাত্রা ছিল ১.৭৪— যা ভূমিকম্পপ্রবণ অঞ্চলগুলোর ক্ষুদ্র ভূকম্পনের সমতুল্য। দ্বিতীয়ার্ধে মোহামেদ সালাহর গোলের পর রেকর্ড হয় ১.৬০ মাত্রার আরেকটি কম্পন। এছাড়া গ্যাকপোর গোলে (১.০৩), উদোগির আত্মঘাতী গোলে (১.৩৫), এমনকি বাতিল হওয়া লুইস দিয়াজের গোলেও (০.৬৪) ধরা পড়ে মাটির হালকা নড়াচড়া।
ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক বেন এডওয়ার্ডস বলেন, “এটি কোনো কাকতালীয় ঘটনা নয়। মানুষের আবেগ থেকে উৎসারিত এই কম্পনগুলো বৈজ্ঞানিকভাবেই রেকর্ড হয়েছে। প্রতিটি গোল যেন তৈরি করছিল একেকটি ক্ষণিকের ভূমিকম্প।”

আরেক গবেষক ফারনাজ কামরানজাদ বলেন, “প্রতিটি উল্লাস, প্রতিটি চিৎকার যেন জমা হয়ে থাকছে অ্যানফিল্ডের মাটির গভীরে— যা যুগে যুগে সাক্ষ্য দেবে এই আনন্দময় মুহূর্তের।”
তবে বিষয়টা শুধু বিজ্ঞান দিয়ে ব্যাখ্যা করা যায় না। এই জয় লিভারপুলের জন্য ছিল আবেগ আর অতীত বেদনারও জবাব। কারণ, এই জয় দিয়েই তারা ছুঁয়ে ফেলেছে ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডের ২০টি লিগ শিরোপার রেকর্ড— ইংলিশ ফুটবলের সবচেয়ে গৌরবময় প্রতিদ্বন্দ্বিতার মুকুট যে এখন দুই ক্লাবের কাছেই।
আরও পড়ুন: মুস্তাফিজের বদলে ‘এ’ দলের স্কোয়াডে খালিদ
প্রসঙ্গত, ঠিক পাঁচ বছর আগে, ২০২০ সালে, যখন ‘কোভিড’ মহামারিতে সারা পৃথিবী স্তব্ধ, সেই সময়ই তিন দশকের অপেক্ষার অবসান ঘটিয়ে লিভারপুল জিতেছিল ইংলিশ প্রিমিয়ার লিগ। কিন্তু তখন ছিল না কোনো উল্লাস, না ছিল ট্রফি নিয়ে শোভাযাত্রা। ছিল শুধু নিঃসঙ্গ শহর আর টিভির পর্দায় দেখা শিরোপা।

সেই না-পাওয়ার বেদনা যেন জমা ছিল অ্যানফিল্ডের প্রতিটি ইটে, প্রতিটি গ্যালারির কাঠে। এবার সেই দীর্ঘদিনের না-পাওয়াগুলো যেন মুক্তি পেল। গর্জে উঠল অ্যানফিল্ড, নেচে উঠল গ্যালারি, আর সেই উদ্দাম উল্লাসই রূপ নিল ভূকম্পনে।
এ যেনো শুধু ট্রফি জয়ের কাহিনি নয়, এ যেন হৃদয়ের গহিন থেকে বেরিয়ে আসা সেই মহারণ, যেখানে ফুটবল আর ভালোবাসা একাকার হয়ে ইতিহাস রচনা করেছে।