আহত সিংহ নাকি আরও হিংস্র হয়। করিম মোস্তফা বেনজেমার গল্পটা যেন ঠিক তেমনই। ইউরোপজয়ী কিংবদন্তি, ব্যালন ডি’অরজয়ী এক মহাতারকা। একা হাতে রিয়াল মাদ্রিদকে ২০২২ এ চ্যাম্পিয়ন্স লিগ জেতানো সেই মানুষটাকেই সৌদি আরবে এসে ‘ফ্লপ’ বলে ট্রল করা হচ্ছিল। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রতিদিনই শিরোনাম হচ্ছিলেন— কখনও কোচের সঙ্গে ঝামেলা, কখনও আবার সৌদিতে আসার সিদ্ধান্তে অনুশোচনা করছেন বলে গুজব। সবকিছুর সাথে যুক্ত হয়েছিল ইনজুরি।
সবাই যখন ধরেই নিয়েছিল শেষের বাঁশি তাহলে বেজেই গেলো বেনজেমার। ঠিক তখনই এই ফ্রেঞ্চ কিংবদন্তি বুঝিয়ে দিলেন একজন আসল লড়াকু সৈনিক এত সহজে হারতে জানে না— এক সময়ের ট্রলের পাত্র থেকে ব্যালন ডি অর জেতা করিম গোটা বিশ্বকে আরেকবার দেখালেন, আসলেই তিনি কে!
আরও পড়ুন: ‘বাংলাদেশ আমার আত্মার ঠিকানা’ — শমিতের হৃদয় ছোঁয়া বার্তা

এই করিম বেনজেমাই এখন সৌদি ফুটবলের রাজা। ফুটবলের আরেক কিংবদন্তি ক্রিস্টিয়ানো রোনালদোকে টপকে হয়েছেন এই মৌসুমের সৌদির সেরা খেলোয়াড়। পুরো মৌসুমে সব প্রতিযোগিতা মিলিয়ে ৩৩ ম্যাচে করেছেন ২৫ গোল, পাশাপাশি দিয়েছেন ৯টি অ্যাসিস্ট। শুধু তাই নয়, আল-ইত্তিহাদকে এনে দিয়েছেন দুটি শিরোপা— সৌদি প্রো লিগের মুকুট আর কিংস কাপ, দুটিই দলের ইতিহাসে দশমবারের মতো এসেছে এক বেনজেমার বদৌলতে।
চলতি মৌসুমে সৌদি লিগে ২১ গোল করে হয়েছেন তৃতীয় সর্বোচ্চ গোলদাতা, সর্বোচ্চ অ্যাসিস্টের তালিকাতেও আছেন শীর্ষ দশে। রোনালদো, মানে, দিয়াবি, মাহরেজ, ফিরমিনোদের পেছনে ফেলে ‘সৌদি লিগের বর্ষসেরা খেলোয়াড়’ নির্বাচিত হয়েছেন তিনিই। যেন ঘুরে দাঁড়ানো এক ক্লাসিক গল্প— ট্রল থেকে ট্রফি, বেনজেমার গল্পটা বীরত্বের!

আর এই গল্পের সেরা অধ্যায়টি লেখা হলো কিংস কাপ ফাইনালে। শুক্রবার রাতে কিং আব্দুল্লাহ স্পোর্টস সিটিতে আল-কাদসিয়াহকে ৩-১ ব্যবধানে হারিয়ে মৌসুমের দ্বিতীয় ট্রফি নিশ্চিত করে আল-ইত্তিহাদ। ম্যাচে জোড়া গোল করেছেন সেই বেনজেমাই।
আরও পড়ুন: রিয়ালের ইতিহাসের পাতায় ইতি টানছেন লুকা মদ্রিচ
প্রথমার্ধে ম্যাচে একচ্ছত্র আধিপত্য বিস্তার করে আল-ইত্তিহাদ। মুসা দিয়াবি ও স্টিভেন বার্গওইনের টানা আক্রমণে ছন্দপতন ঘটে প্রতিপক্ষের রক্ষণভাগে। ৩৪ মিনিটে প্রথম গোল করেন বেনজেমা। ডান দিক থেকে বার্গওইনের বাড়ানো ক্রস বুক দিয়ে পোস্টে ঠেলে দেন তিনি। নিখুঁত সময়জ্ঞান, দুর্দান্ত পজিশনিং— এই গোলটা যেন তাঁর ক্যারিয়ারের সারসংক্ষেপ হয়ে উঠল।
এর ৯ মিনিট পর আরও একটি আক্রমণ। এবার ডান প্রান্ত থেকে দিয়াবির ক্রসে বেনজেমা হেড করলেও গোলকিপার তা ফিরিয়ে দেন, তবে ফিরতি বল জালে পাঠান হাউসেম আওয়ার। বিরতির ঠিক আগ মুহূর্তে কাদসিয়াহ পেনাল্টি থেকে ব্যবধান কমায়, গোল করেন পিয়েরে-এমেরিক অবামেয়াং।

দ্বিতীয়ার্ধে ম্যাচে ফেরার মরিয়া চেষ্টা করে কাদসিয়াহ। কিন্তু এক রেড কার্ডে ভেঙে পড়ে তাদের পরিকল্পনা। এজেকিয়েল হার্নান্দেজ দ্বিতীয়বার হলুদ কার্ড দেখে মাঠ ছাড়লে ১০ জনের দলে পরিণত হয় তারা। সেই সুযোগ কাজে লাগিয়ে আরও একবার গোলরক্ষণের মুখে পৌঁছে যায় আল-ইত্তিহাদ। অতিরিক্ত সময়ে ডান নয়, এবার বাঁ পাশ দিয়ে বল বাড়ান দিয়াবি, এবং এক টানে বল জালে পাঠিয়ে দেন করিম বেনজেমা।
আরও পড়ুন: রোনালদো জুনিয়রের জোড়া গোলে চ্যাম্পিয়ন পর্তুগাল
তাঁর সেই উদযাপন ছিল যেন সিম্বলিক— হাত দুটো আকাশের দিকে ছড়িয়ে ধরে শুধু একবার তাকান ওপরে। যেন বলতে চান, “এই ট্রফিটা আমার জন্যই লেখা ছিল।”

ম্যাচ শেষে পুরো জেদ্দা যখন উদযাপনে মাতোয়ারা, তখন মাঠের ঠিক মাঝখানে একজন ফরাসি তারকা নিঃশব্দে উদযাপন করছিলেন নিজের মতো করে। ইউরোপের গ্ল্যামার, ব্যালন ডি’অর, গোলের রেকর্ড— সব পেছনে ফেলে এসে যেন নতুন করে নিজেকে আবিষ্কার করেছেন সৌদি মরুভূমিতে। শুধু নিজের নয়, আল-ইত্তিহাদকেও এনে দিয়েছেন ইতিহাসের অংশ হওয়ার সুযোগ।
এক মৌসুম আগেও যাকে নিয়ে রীতিমতো ব্যঙ্গচিত্র আঁকা হতো সামাজিক মাধ্যমে, সেই বেনজেমা এখন সৌদি ফুটবলের সবচেয়ে আলোচিত নাম। যার নেতৃত্বে আল-হিলালের একচ্ছত্র রাজত্বে ফাটল ধরিয়ে, লিগ আর কাপ— দুই ট্রফিই নিজেদের ঘরে তুলেছে আল-ইত্তিহাদ।
আরও পড়ুন: ব্রাজিলের কোচ হলেন কার্লো আনচেলত্তি
শুধু গোলের পরিসংখ্যান নয়, মাঠে তাঁর খেলার ধরনটাও যেন এখনো আটকে আছে ২০২২ সালেই— যখন তিনি ব্যালন ডি’অর জিতেছিলেন। ফিনিশিং, পাসিং, বল কন্ট্রোল, রান। সব মিলিয়ে এখনো খেলেন ঠিক সেসময়ের মতোই। যেন থেমে যাওয়া এক ঘড়ি, যেটা চলছেই নিজের গতিতে।

আমরা যখন ‘বুড়োদের জাদু’ বলি, তখন অনিবার্যভাবে রোনালদোর নাম আসে। লুকা মদ্রিচকেও আমরা মনে করি সেই তালিকার একজন। কিন্তু এখন যদি প্রশ্ন করা হয়— বুড়োদের সেরা তিনে কাকে রাখবেন? তাহলে করিম বেনজেমার নাম না নিয়ে পারবেন না কেউই।
যাঁকে একসময় ‘লর্ড’ বলে ট্রল করা হতো, যাঁর ক্যারিয়ারের শুরুতে বলা হতো ‘অতিমূল্যায়িত স্ট্রাইকার’, সেই করিম মোস্তফা বেনজেমা এখন ‘ওয়ান্স ইন আ লাইফটাইম ফুটবলার’। কদু থেকে রাজা, সেখান থেকে কিংবদন্তি হয়ে ওঠার এই পথটা সহজ ছিল না মোটেই। কিন্তু প্রতিটা পদক্ষেপেই তিনি দেখিয়েছেন— আসল খেলোয়াড়দের বিচার হয় সময়ের পরীক্ষায়, ট্রল নয়।
আরও পড়ুন: বাংলাদেশে আসতে চান কুইন সুলিভান
এই জয়ে শুধু বেনজেমা নয়, তাঁর ক্লাব আল-ইত্তিহাদও সৌদি ফুটবলের ইতিহাসে জায়গা করে নিয়েছে আরও একবার। এক মৌসুমে লিগ এবং কাপ— ডাবল ট্রফি জয় করে তাঁরা এখন সৌদি ফুটবলের গর্ব। এবং এই ইতিহাসের কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছেন একজনই— সেই করিম বেনজেমা।

সৌদি মাটিতে এই এক মৌসুমে তিনি দেখিয়ে দিলেন— ফুটবল শুধু গতির খেলা নয়, এটি অভিজ্ঞতা, চরিত্র আর বারবার ঘুরে দাঁড়াবার গল্পও। বয়স শুধু সংখ্যা, আর সেই সংখ্যার ওপারে দাঁড়িয়ে একজন মানুষ আজও বলে যেতে পারেন—”আমি করিম বেনজেমা। আমি এখনো ফুরিয়ে যাইনি।”
আরও পড়ুন: রোনালদোর সঙ্গে দ্বৈরথ ফুটবলের শ্রেষ্ঠ অধ্যায়: মেসি