ফাস্ট বোলিংয়ের ইতিহাসে যদি সর্বকালের সেরা ডেলিভারির কথা বলা হয়, তাহলে দুটি নাম অবধারিতভাবে চলে আসে—রায়ান হ্যারিস ও মোহাম্মদ আসিফ। ২০১৩/১৪ অ্যাশেজে অ্যালিস্টার কুককে আউট করতে হ্যারিস এমন একটি দুর্দান্ত ডেলিভারি করেছিলেন, যা ইএসপিএন ক্রিকইনফো “শতাব্দীর সেরা বল” বলে অভিহিত করেছিল। তবে, হ্যারিসের এই ডেলিভারিতে ওয়াকা পিচের ফাটল গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিল যা বলের গতিপথে পরিবর্তন আনে।
কিন্তু ২০০৬ সালের করাচি টেস্টে ভিভিএস লক্ষ্মণকে বোল্ড করা মোহাম্মদ আসিফের বলটি শুধুই তার নিখুঁত বোলিং প্রতিভাকে প্রমাণ করে, যা তিনি পিচের থেকে তেমন কোনো সাহায্য ছাড়াই করেছিলেন। Scrambled seam-এ করা বলটি অন্য কোনো সাধারণ বলের মতোই আসিফের হাত থেকে সোজা এসে অফ স্টাম্পের বাইরে গুড লেন্থে পিচ করে। কিন্তু পিচে পড়ার পর যা হলো, তা শুধু ভিভিএস লক্ষ্মণকেই নয়, পুরো ক্রিকেট বিশ্বকে অবাক করে দিয়েছিলো। বলটি আচমকা অফ-স্পিনের মতো ব্যাট ও প্যাডের মাঝে ঢুকে অফ স্টাম্পকে আঘাত করে। এইভাবেই ক্রিকেটের অভিধানে যুক্ত হলো এক নতুন শব্দ – দ্যা ওবোল সিম ডেলিভারি, সংক্ষেপে দ্যা ওবোলার।
এই ডেলিভারি ব্যাটসম্যানদের কাছে এত ভীতিকর কেন, তা বুঝতে হলে আমাদের আগে সুইং ও সিম বোলিং-এর মধ্যে পার্থক্যটা জানতে হবে।

সুইং বোলিং ও সিম বোলিং এর পার্থক্য
সুইং বোলিং এর উদ্দেশ্য হলো বাতাসে বলের গতিপথে পরিবর্তন আনা। এজন্য বোলার বলের সিমকে সেকেন্ড স্লিপ ( আউটসুইং) বা ফাইন লেগের ( ইনসুইং) দিকে তাক করে বলটি হাতে থেকে ছুড়ে। বলটি ছোঁড়ার সময় বোলার নিজের হাতকে এক উপবৃত্তাকার পথে উপর থেকে নিচে নামায় যা বলকে সুইং করাতে সাহায্য করে।
আরও পড়ুনঃ ড্রাই পিচ কেনো স্পিনারদের স্বর্গ?
অন্যদিকে, সিম বোলিংয়ে মূলত পিচ থেকে গতি বা দিক পরিবর্তন করানোর চেষ্টা করা হয়। সিম-আপ ডেলিভারি করতে বোলার বলের সিমকে একদম সোজা বা bolt upright position এ রাখেন। পিচে পড়ার সময় সিমের উপরে লাগলে বল ভেতরে বা বাইরে যেকোনো দিকে যেতে পারে।
বল যদি লেট সুইং না হয়ে বোলারের হাত থেকে ছোঁড়ার পরপরই বাতাসে সুইং হওয়া শুরু করে, তাহলে অভিজ্ঞ ব্যাটারদের জন্য সেটি মোকাবেলা করা তুলনামূলকভাবে সহজ। কিন্তু সিম বোলিং এর ক্ষেত্রে বলটি বাতাসে সোজা পথে আসলেও, পিচের সাথে সংস্পর্শে এসে গতিপথ পরিবর্তন করে। তাই ব্যাটসম্যান সিম মুভমেন্টের ক্ষেত্রে প্রতিক্রিয়া করার সময় কম পান। এজন্য, সুইং এর থেকে সিম মুভমেন্ট বেশি কার্যকরী।

তাহলে, ওবোল সিমের প্রয়োজন কেন?
ফ্লাট পিচে সাধারণ সিম বল করে মুভমেন্ট পাওয়া অনেকটাই অসম্ভব। এক্ষেত্রে বল সরাসরি সিমের উপর পড়লেও গতিপথে কোনো পরিবর্তন আসে না। তাই ব্যাটসম্যানকে এ ধরনের বল মোকাবেলায় তেমন বেগ পেতে হয় না। তাছাড়া সিম বোলিং এ বোলার কোন দিকে বল মুভমেন্ট করাতে চান সে হিসেবে হাতের আঙুল ও কবজির পজিশনে কিছুটা পরিবর্তন আনেন। আন্তর্জাতিক ক্রিকেটের অভিজ্ঞতাসম্পন্ন ব্যাটাররা এই পরিবর্তন বল রিলিজ করার সময় ধরে ফেলতে পারেন এবং আগ থেকেই সিম মুভমেন্টের অনুমান করতে পারেন।
ওবোল সিমে এই অনুমান সম্ভব নয়। বোলার নিজেও জানেন না বল পিচ করার পর কোন দিকে যাবে । বাতাসে বলের সিম পজিশন সিম-আপ ডেলিভারির মতো স্থির না থেকে সামান্য দুলতে থাকে, ফলে বল পিচ করার পর কোন দিকে যাবে তা নিয়ে অনিশ্চয়তা তৈরি হয়। ব্যাটাররা যত অভিজ্ঞই হোক না কেন, চোখে দেখে বা অভিজ্ঞতায় এই মুভমেন্ট আগেভাগে ধরা যায় না।

কীভাবে কাজ করে ওবোল সিম?
একটি ওয়োবল সিম ডেলিভারিতে বল ৪ ধরনের আচরণ করতে পারে –
১. বল পিচ করার পর ভিতরে ঢুকবে
২. বল পিচ করার পর বাইরে যাবে
৩. বলের সিম যদি সোজাসুজিভাবে অবস্থায় পিচ করে, তাহলে বলটি সোজা যাবে।
৪. যদি বলের লেদার পার্ট পিচে আঘাত করে, তাহলে বলটি স্কিড করবে।
সিম-আপ ডেলিভারিতে বলের সিম পজিশন স্থির থাকে। কিন্তু ওবোল সিমে বলের সিম পজিশন ঘড়ির কাটার ১১ থেকে ১টার মধ্যে দুলতে থাকে, ফলে বল কোথায় গিয়ে পড়বে তা বোঝা যায় না।
আরও পড়ুনঃ ৩০০ কোটি নয়, নিজের স্বপ্নকেই বেছে নিলেন কোহলি
ওবোল সিম ডেলিভারি করার কৌশল
ওবোল সিম ডেলিভারি করতে দুটি পদ্ধতি অবলম্বন করা যায়—
১. তর্জনী ও মধ্যাঙ্গুলের মাঝে দুরত্ব বাড়িয়ে : সাধারণ সিম-আপ ডেলিভারিতে বোলার বলের সিমের উপরে তর্জনী ও মিডল ফিঙ্গার একসাথে রাখেন। ওবোল সিমে এই দুটি আঙুলের মধ্যে সামান্য ফাঁক রাখতে হয়।এই দুই আঙুলের দুরত্ব বলের সিমের স্থিরতা নষ্ট করে, ফলে হালকা দুলুনি তৈরি হয়, যা বাতাসে সামান্য সুইং এবং পিচ করার পড়ে অনিশ্চিত মুভমেন্ট তৈরি করে।

২. সিম ক্যান্টিং করা (Canting the Seam) : সিম-আপ গ্রিপের মতোই আঙুলের অবস্থান রাখতে হয়, কিন্তু সিমটিকে সামান্য কাত করতে হয়। সিম পজিশন ঘড়ির কাটার ১২টার দিকে না থেকে সামান্য ১১ বা ১টার দিকে থাকে।

ওবোল সিমের কার্যকারিতা কেন এত ভীতিকর?
ওয়োবল সিমে বোলার নিজেই বলতে পারবে না যে বল পিচ করার পর কোন দিকে যাবে, তাই ব্যাটসম্যানের জন্য আগে থেকে সেটি বুঝতে পারা তো দূরের কথা। যদি অফ স্টাম্পের লাইনে গুড লেন্থে এই বলটি পিচ করে, তাহলে ব্যাটসম্যান দ্বিধায় থাকে যে বলটি ভিতরে ঢুকবে দেখে ডিফেন্স করবে নাকি বাইরে যাবে বলে ছেড়ে দিবে। তাই ব্যাটারদের জন্য ওয়োবল সিম এক রহস্যই হয়ে থাকবে।
ওয়োবল সিমের জনক কে তা নিয়ে কিছু বির্তক আছে। কারো মতে অস্ট্রেলিয়ার স্টুয়ার্ট ক্লার্ক এর উদ্ভাবক তো কারো মতে আবার শন পোলক। তবে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে ওয়োবল সিমের সবচেয়ে কার্যকরী প্রদর্শন দেখিয়েছেন পাকিস্তানের মোহাম্মদ আসিফ। তাই এখনও কেভিম পিটারসেন ও এবিডি ভিলিয়ার্সের মতো ব্যাটসম্যানরা আসিফের এই অনন্য প্রতিভার স্মরণ করেন।
বর্তমান সময়ে যেসব বোলার ওয়োবল সিমের কার্যকর প্রয়োগ করেছেন তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য-
জেমস অ্যান্ডারসন – সুইংয়ের পাশাপাশি ওবোল সিমে সমান পারদর্শী।
প্যাট কামিন্স – ফ্ল্যাট পিচে নিয়মিত ওবোল সিম ব্যবহার করেন।
মোহাম্মদ সিরাজ – নতুন বলের পাশাপাশি ওবোল সিমের সাহায্যে পুরনো বলেও মুভমেন্ট বের করেন।
মিচেল স্টার্ক – গতি আর ওবোল সিমের মিশেলে মারাত্মক কার্যকর।
মোহাম্মদ আব্বাস – গতি কম হলেও নিখুঁত সিম কন্ট্রোলের জন্য বিখ্যাত।
টিম সাউদি – নিউজিল্যান্ডের কন্ডিশনে ওবোল সিমের সফল প্রয়োগ দেখিয়েছেন। ওবোল সিম ডেলিভারি আধুনিক ক্রিকেটে ফাস্ট বোলারদের সবচেয়ে কার্যকর অস্ত্রগুলোর মধ্যে একটি। ফ্ল্যাট পিচে যখন সুইং বা সিম বের করা কঠিন হয়ে যায়, তখন এই ডেলিভারি নতুন করে আশা জাগায়। যখন বল বাতাসে অদ্ভুত দোল খায়, তখন শুধু ব্যাটার নয়, সম্পূর্ণ ক্রিকেট বিশ্বকেই অবাক করে তোলে ওবোল সিমের রহস্য।
আরও পড়ুনঃ বেঙ্গালুরুর চেনা মাঠই যেনো দুঃস্বপ্ন