সুনীল ফিলিপ নারাইন, রহস্যময় স্পিন করে বছরের পর বছর ব্যাটারদের কাবু করে গেছেন। রহস্যময় স্পিন করে বহুদিন ব্যাটারদের বোকা বানানোর এমন উদাহরণ আপনি ক্রিকেটবিশ্বে খুব একটা পাবেন না। আধুনিক ক্রিকেটে রহস্যময় স্পিন, বা ইংরেজিতে যেটাকে বলে ‘Mystery Spin’ — এই মিস্ট্রি স্পিনের শুরুটা বোধহয় শ্রীলঙ্কান অজন্তা মেন্ডিসের হাত ধরে শুরু হয়। তবে অজন্তার ক্যারিয়ারটা লম্বা হয়নি, ইঞ্জুরি ও তার রহস্যের সমাধান ব্যাটাররা খুঁজে বের করে ফেলায়। কিন্তু সেই কবে ক্রিকেটটা শুরু করেছেন সুনীল নারাইন। সেই ২০১১ সাল থেকে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে পা রেখেছেন, আজ ২০২৫ চলছে; সুনীল নারাইনের রহস্য যেন আজও দুর্বোধ্য। তবে সেই রহস্য খুঁজে বের করার চেয়েও বোধহয় এই রহস্য আরো দুর্বোধ্য যে, সুনীল নারাইন কেনো হাসেন না?

আরও পড়ুন: ম্যাচ হারের পুরো দায় নিজের কাঁধে নিলেন ধোনি
ক্রিকেট খেলার সময় আমরা অনেক খেলোয়াড়কে দেখি যারা উইকেট পেলে উচ্ছ্বাস করে, হাত উঁচিয়ে চিৎকার করে, দৌড় দেয়, দলকে নিয়ে উদযাপন করে। আপনার হয়তো ইমরান তাহিরের নাম শুনলেই আপনার চোখে ভেসে উঠবে উইকেট নিয়ে সেই ভোঁ দৌড় ; কিংবা বাংলাদেশের ইবাদত হোসেন চৌধুরীর ট্রেডমার্ক স্যালুট; অনেক খেলোয়াড়েরই নিজেদের চিরচেনা উদযাপন থাকে। আবার যাদের আলাদা করে কোনো উদযাপন নেই, তারা হয়তো গতানুগতিক কোনো উদযাপনই করেন। ম্যাচ জিতলেও তারা আনন্দে মেতে ওঠে, একে অপরকে জড়িয়ে ধরে, হাসে। এই ‘হাসি’টা অন্তত সবার মুখে থাকে। কিন্তু এই জায়গাতেও রয়ে গেলো এক ব্যতিক্রম, অনেক ভালো খেললেও মুখে কোনো অভিব্যক্তি থাকে না— নামটা সুনীল নারাইন। কেনো হাসে না সুনীল, এ নিয়ে তো রহস্যের শেষ নেই, সেই রহস্যেরই উন্মোচনের জন্য সুনীলকে নিয়ে কিছু লেখা যাক।

সুনীল নারিন আইপিএল-এ খেলা শুরু করেছেন ২০১১ সালে। তখন থেকেই কলকাতা নাইট রাইডার্স (কেকেআর) দলের একজন গুরুত্বপূর্ণ সদস্য তিনি। চৌদ্দ বছরের আইপিএল ক্যারিয়ারে অনেক ম্যাচ জিতিয়েছেন, অনেক উইকেট নিয়েছেন। কিন্তু কখনো তাঁকে সেভাবে সেলিব্রেট করতে দেখা যায়নি। কেকেআর এর হয়ে ১৮৬ ম্যাচে ১৯০ উইকেট নিলেন, ইকোনমি কেবল ৬.৭৭! আইপিএলের মত টি-টোয়েন্টি লীগে সাতের কম ইকোনমিতে বল করা যে কত বড় কিছু, সেটা হয়তো ক্রিকেটপ্রেমীদের আলাদা করে বুঝিয়ে বলার কিছু নেই। এই কেকেআরের হয়েই বেরিয়ে আসে নারাইনের ব্যাটিং সত্ত্বাও, ২০১৭ আইপিএলে হুট করেই কলকাতা ওপেনিংয়ে পাঠিয়ে দেন এই লোয়ার অর্ডার ব্যাটারকে। এরপর থেকে যেন নারাইন হয়ে গেলেন টি-২০ ক্রিকেটের এক অন্যতম ইমপ্যাক্টফুল অল-রাউন্ডার। টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটে শতকও হাঁকিয়েছেন এই কলকাতার হয়ে। মজার বিষয়, এই শতকও হাসি ফোটাতে পারেনি সুনীল নারাইনের মুখে!

আরও পড়ুন: রিশাদ-রানার প্রশংসায় পঞ্চমুখ সিকান্দার রাজা
এই জন্য অনেকেই তাকে নিয়ে মজা করে। কেউ বলেন, তিনি নাকি কোনোদিন হাসেন না। কেউ বলেন, তিনি নাকি রোবটের মতো। এমনকি কেকেআরের সমর্থকরাও বলেন, গম্ভীর আর নারিন—দুজনের মধ্যে কে কম হাসেন, তা নিয়ে প্রতিযোগিতা করা যায়! তবে আশ্চর্যের বিষয় হলো, মাঠের বাইরে নারিন একেবারেই অন্য মানুষ। তিনি নাচতে পারেন, মজা করতে পারেন, অনেক ভালো কথা বলেন। দলের পার্টিতে সবাইকে হাসাতে পারেন। সদ্য এক প্রাক্টিসের ছবিতে দেখা গেলো সুনীল নারাইন দিব্যি সতীর্থদের সাথে হেসেখেলে মজা করছেন। এমনকি তাঁর ক্রিকেট নিয়ে জ্ঞানও অনেক বেশি। আইপিএলে নিজের কোন ম্যাচে কী করেছেন, কোন ব্যাটসম্যানের বিপক্ষে কেমন বল করেছেন, সব মুখস্থ বলতে পারেন। একবার শুভমান গিল হাফসেঞ্চুরি করার পর জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল এটা তাঁর কততম হাফসেঞ্চুরি। গিল নিজেও মনে করতে পারেননি। কিন্তু নারাইন সঙ্গে সঙ্গে বলে দেন সঠিক সংখ্যাটা!

তাহলে প্রশ্ন আসে, মাঠে তিনি এত চুপচাপ কেন? উইকেট পেলেও কেন উচ্ছ্বাস দেখান না? ম্যাচ জিতলেও কেন হাসেন না? ত্রিনিদাদ ও টোবাগোর ক্রিকেটার সুনীল নারাইনের এই চুপ থাকার পেছনে আছে একটি ছোট কিন্তু গভীর কারণ। নারাইনের বাবা একসময় তাঁকে বলেছিলেন, “আজ তুমি যাকে আউট করে সেলিব্রেট করছো, সে হয়তো কাল তোমার বিরুদ্ধে খেলবে। তখন সে যদি তোমাকে আউট করে, তুমি তার মুখোমুখি হবে কীভাবে? তুমি কি নিশ্চিত যে সে তোমাকে ছেড়ে দেবে?” — এই কথাগুলো নারাইনের মনে গেঁথে গেছে। তিনি বুঝেছেন, খেলা শুধু প্রতিদ্বন্দ্বিতা নয়, এখানে সম্মানও জরুরি। প্রতিপক্ষকেও শ্রদ্ধা করা উচিত। তাই তিনি কখনো অতিরিক্ত সেলিব্রেশন করেন না। তিনি চুপচাপ থাকেন, কারণ তিনি বিশ্বাস করেন, একজন ভালো খেলোয়াড়ের উচিত নিজের কাজ মন দিয়ে করে যাওয়া, বেশি কিছু না দেখানো।
একবার কেউ তাঁকে জিজ্ঞাসা করেছিলেন, “তোমার ক্যারিয়ারের শেষ ম্যাচে যদি উইকেট পাও, তখন কি তুমি সেলিব্রেট করবে? তখন তো আর প্রতিপক্ষের সঙ্গে দেখা হবে না।” নারাইন মজা করে উত্তর দিয়েছিলেন, “কমেন্ট্রি বক্সে যদি দেখা হয়ে যায়, তখন কী হবে?”এই কথাটা শুনেই বোঝা যায়, নারাইন কতটা ভদ্র, চিন্তাশীল আর সংযমী একজন মানুষ। তিনি বিশ্বাস করেন, মাঠে কারও ক্ষতি করে আনন্দ করা উচিত নয়। যিনি আজ আউট হয়েছেন, কাল তিনিও ম্যাচ জেতাতে পারেন। তাই কারও বিপদে খুশি হওয়া ঠিক না। বাংলাদেশের হাসান মাহমুদও ঠিক এমন একটা মন্তব্যই করেছিলে, ব্যাটারদের আউট করে সেলেব্রেশন না করার কারণ হিসেবে৷
সুনীল নারাইন হাসেন না, কারণ তিনি ভদ্রতা আর শ্রদ্ধার ওপর বিশ্বাস করেন। তিনি মনে করেন, খেলার মাঠে প্রতিপক্ষের সম্মান রাখা দরকার। তিনি কোনো কিছুর বাড়াবাড়ি করেন না—না জয়ের সময়, না ব্যর্থতার সময়। তিনি নিজের কাজটা নিঃশব্দে করে যান। এটাই নারাইনের আলাদা পরিচয়। এ কারণেই নারাইন আমাদের সবার থেকে একটু আলাদা।