বুধবার, জুন ২৫, ২০২৫
সামি'স কর্নার

এক যুগের অবসান, ডি ব্রুইনার বিদায়ে থমকে গেলো ইতিহাদ

ইতিহাদ স্টেডিয়ামের আকাশজুড়ে ছিল এক ধরনের নীরবতা, যেটা গর্ব আর কষ্টের মিশেলে জন্ম নেয়। মঙ্গলবার (২০ মে) রাতে কেভিন ডি ব্রুইনা শেষবারের মতো ম্যানচেস্টার সিটির হয়ে হোম ম্যাচ খেলতে নামলে, সময় যেন একটু থমকেই দাঁড়ায়। দশ বছরের এক অসাধারণ যাত্রা, যেখানে ফুটবলের ভাষা বদলে দিয়েছিলেন এক বেলজিয়ান জাদুকর— সেই অধ্যায়ের অবসান যেন কেউ মানতে চাচ্ছিল না।

৩৩ বছর বয়সী এই মিডফিল্ডার ছিলেন ম্যানচেস্টার সিটির হৃদস্পন্দন। ম্যাচের গতি বদলে দেওয়া, অসম্ভবকে সম্ভব করে তোলা, কিংবা নিখুঁত এক পাসে পুরো রক্ষণভাগকে বিভ্রান্ত করা —ডি ব্রুইনার মতো করে তা আর কেউ করেননি। তার ফুটবল মানে শুধু গোল কিংবা অ্যাসিস্ট নয়, ছিল শিল্পের মতো সৌন্দর্য। এমন একজন খেলোয়াড়ের বিদায়ে, সিটির ডাগআউট থেকে গ্যালারি পর্যন্ত— সবাই যেন একসাথে কেঁদে উঠলো।

আরও পড়ুন: রোনালদোর সঙ্গে দ্বৈরথ ফুটবলের শ্রেষ্ঠ অধ্যায়: মেসি

ডি ব্রুইনার পরিসংখ্যান নিজেই তার কিংবদন্তি হয়ে ওঠার সাক্ষ্য দেয়। প্রিমিয়ার লিগে ২৮৩ ম্যাচে অংশ নিয়ে ৭২টি গোল করেছেন, সঙ্গে ১১৯টি অ্যাসিস্ট— যা ইপিএলের ইতিহাসে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ। তবে সংখ্যার বাইরেও, তার তৈরি করা ৮৪৩টি গোলের সুযোগই বলে দেয়, কতটা সৃজনশীল আর প্রভাবশালী ছিলেন তিনি। ম্যানচেস্টার সিটির হয়ে চ্যাম্পিয়ন্স লিগ থেকে ইংলিশ প্রিমিয়ার লিগ, জেতা বাদ রাখেননি কিছুই। ব্রুনো ফার্নান্দেজ, সালাহ, সন কিংবা অন্য লিগের কোনো জাদুকর— এই সময়ে যারা দুর্দান্ত ছিলেন, তাদের সবার ওপরে ছিল এই ‘প্লেমেকিং ইউনিকর্ন’।

তবে মঙ্গলবারের ম্যাচটি ছিল শুধুই আরেকটি পরিসংখ্যান যোগ নয়। এটি ছিল আবেগের এক অধ্যায়। ইতিহাদে এটি ছিল তার ১৪২তম হোম ম্যাচ— যা স্প্যানিশ ডেভিড সিলভার পরে সবচেয়ে বেশি। ম্যাচের পর তাকে ঘিরে তৈরি হয় এক আবেগঘন পরিবেশ, যেটি সিটি বস পেপ গার্দিওলাকেও ছুঁয়ে যায়। কোচ বলেন, “এই দিনটা সত্যিই খুব কষ্টের। সবাই দেখেছে, কেভিন আর তার পরিবারের প্রতি ম্যানচেস্টার সিটির মানুষের ভালোবাসা কতটা গভীর। ট্রফি জেতার চাইতেও বড় কিছু হচ্ছে দশ বছর পর এত সম্মান নিয়ে বিদায় নেওয়া। ওকে সবাই মিস করবে, এ ব্যাপারে কোনো সন্দেহ নেই।”

তবে বিদায়টা পুরোপুরি নিজের ইচ্ছায় নয়। নতুন চুক্তি না পাওয়াটা ছিল তার জন্যও অপ্রত্যাশিত। ডি ব্রুইনা পরে স্বীকার করেন, “আমি ভাবিনি সিটি আমাকে ছাড়বে। এটা আমার পরিবার, আমার ঘর। আমার ছেলেরাও এখন ম্যানচেস্টারেই বড় হচ্ছে।” এমন কথার ভেতরে লুকিয়ে ছিল এক অপ্রকাশিত কষ্ট, এক অসমাপ্ততার গ্লানি।

আরও পড়ুন: টানা তৃতীয়বারের মতো বার্ষিক আয়ে শীর্ষে রোনালদো

তার ভবিষ্যৎ নিয়ে অনেক গুঞ্জন চলছে। ইউরোপিয়ান মিডিয়ার দাবী ব্রুইনা ইংলিশ প্রিমিয়ার লিগেই থাকবে। আবার কারো মতে, পরবর্তী গন্তব্য হলো যুক্তরাষ্ট্রের ক্লাব শিকাগো ফায়ার।  মাঝমাঠের এই জাদুকরকে অনেকে দেখছেন সৌদির কোনো ক্লাবেও। তবে যেখানেই যাক কেভিন, সেখানে হয়তো আরেকটি অধ্যায়ের সূচনা করবেন। কিন্তু, ইতিহাদ তাকে মনে রাখবে তার সেরা রূপে— একটা প্রজন্মের জন্য অনুপ্রেরণা হয়ে।

তবে ডি ব্রুইনার বিদায়ের সঙ্গে সঙ্গেই একটা বড় প্রশ্ন উঠে এসেছে— কে সিটির মাঝমাঠে সেই ভার নেবে, যেটা এতদিন কাঁধে তুলে নিয়েছিলেন ডি ব্রুইনা?

সিটি শুরুতে নজর দিয়েছিল বায়ার লেভারকুসেনের ফ্লোরিয়ান ভের্টজের দিকে। অনেকে ভাবছেন অন্য কোনো তরুণ মিডফিল্ডার। কিন্তু বাস্তবতা হলো, ডি ব্রুইনার জায়গা পূরণ করা এত সহজ নয়।

তবে সিটির ভেতরেই রয়েছে সম্ভাব্য উত্তর। জ্যাক গ্রিলিশ ও ফিল ফোডেন— এই দুই ইংলিশ মিডফিল্ডার এই মৌসুমে নিয়মিত ছিলেন না, কিন্তু দু’জনেই প্রতিভার ঝলক দেখিয়েছেন বহুবার। বিশেষ করে ফোডেন, যাকে নিয়ে বিশেষ প্রত্যাশা গড়ে উঠেছে। মাইকা রিচার্ডস যদিও স্পষ্টভাবেই বলেন, “কেভিনের বিকল্প হয় না। কিন্তু ফোডেনের মধ্যে সামর্থ্য আছে সেই দায়িত্ব নেওয়ার। এখন সময় এসেছে নিজেকে প্রমাণ করার।”

আরও পড়ুন: বাবর-রিজওয়ানদের ছাড়াই পাকিস্তানের স্কোয়াড ঘোষণা 

ফোডেনের জন্য এটাই হতে পারে নিজেকে প্রমাণের সিজন। ডি ব্রুইনার শূন্যতা শুধু মাঠে না, ড্রেসিং রুমেও বিরাট প্রভাব ফেলবে। সেখানে একজন নেতা, একজন পথপ্রদর্শকের অভাব দেখা দেবে। এই পরিস্থিতিতে ফোডেন যদি নিজের চরিত্রের পরিপক্বতা দেখিয়ে পারফর্ম করতে পারেন, তাহলে হয়তো তিনিই হতে পারেন নতুন যুগের প্রতিনিধি।

সিটির জন্য সামনের সময়টা কঠিন হতে চলেছে। নতুন মৌসুমের পরিকল্পনা, দলগঠন, আর কৌশলগত সিদ্ধান্ত— সবকিছুর মূলে থাকবে এই একটি প্রশ্ন: কে হবে ডি ব্রুইনার উত্তরসূরি? গার্দিওলা অবশ্য বলেন, “কেভিনের বিকল্প কখনো পাওয়া যাবে না। আমাদের অন্যভাবে ভাবতে হবে, নতুন এক পরিচয় গড়তে হবে।”

এছাড়া পেপ আরও বলেন, “ক্লাবে যখন সে এসেছিল, তখন সে ম্যান সিটির সমর্থক ছিল না— সেটা নিশ্চিত। কিন্তু আজ সে সিটি পরিবারের এক অবিচ্ছেদ্য অংশ। এখন সে সিটি সমর্থক, এবং সারাজীবন তাই থাকবে।”

ডি ব্রুইনার প্রতি ভালোবাসা দেখানোর জন্য ক্লাব ইতোমধ্যে ঘোষণা দিয়েছে, তার নামে ইতিহাদের বাইরে স্থাপন করা হবে একটি ভাস্কর্য। আর সেই স্মারক সবাইকে মনে করিয়ে দিবে, কিভাবে এক বেলজিয়ান ফুটবলার ফুটবলকেই শিখিয়েছেন নতুন ভাষায় কথা বলতে।

আরও পড়ুন: লাহোরে পৌঁছে গেছেন মিরাজ

বিদায়ের দিনে ডি ব্রুইনা নিজের ভাষণেও ফুটিয়ে তুলেছেন আবেগ। নিজের বিদায়ী ভাষণে ডি ব্রুইনা বলেন, “আমি ফুটবলটা খেলতে চেয়েছি সাহস আর কল্পনাশক্তি দিয়ে। চেয়েছি উপভোগ করতে। আশা করি, আমার খেলা দেখে সবাই আনন্দ পেয়েছে। এই ক্লাবে ভেতর-বাইরের সবাই আমাকে আরও ভালো বানিয়েছে। যারা আমার পাশে ছিল, তারা আজীবনের বন্ধু হয়ে গেছে। এই পথচলা ছিল দারুণ এক অভিজ্ঞতা।”

শেষ বাঁশির পর পুরো দল যখন একসাথে দাঁড়িয়ে তাকে ঘিরে অভিনন্দন জানায়, তখন বোঝা যায়, এই মানুষটা শুধু খেলোয়াড় ছিলেন না— তিনি ছিলেন প্রেরণার প্রতীক। বিদায়ের মুহূর্তে যে ভালোবাসা তিনি পেয়েছেন, সেটি হয়তো কোনো ট্রফির থেকেও বড়।

ডি ব্রুইনার গল্পটা ছিল সাহস, কল্পনা আর নৈপুণ্যের এক মহাকাব্য। আর তার যাত্রার শেষটা, যতটা না বিদায়, তার চেয়ে বেশি— এক নতুন অধ্যায়ের শুরু। এখন দেখার পালা, ফোডেন কিংবা অন্য কেউ কীভাবে এই শূন্যতা পূরণ করতে পারেন।

সিটি সামনের দিকে তাকিয়ে আছে। কিন্তু পেছনে রেখে যাচ্ছে এমন এক কিংবদন্তিকে, যার অবদান কখনোই ভুলে যাওয়ার নয়। ডি ব্রুইনার মতো খেলোয়াড় বারবার আসে না— তাকে হয় অনুভব করতে হয়, শ্রদ্ধা জানাতে হয়, আর বিদায়ের দিনে ভালোবাসার শেষটুকু উজাড় করে দিতে হয়।

আরও পড়ুন: রোনালদো জুনিয়রের জোড়া গোলে চ্যাম্পিয়ন পর্তুগাল

আরও খবর

একটি মন্তব্য করুন

দয়া করে আপনার মন্তব্য লিখুন
দয়া করে এখানে আপনার নাম লিখুন

সর্বশেষ খবর

জনপ্রিয় খবর