বৃহস্পতিবার, জুন ২৬, ২০২৫
সামি'স কর্নার

শিরোপা খরা কাটিয়ে পুনর্জন্মের গল্পে মোড়া ২০২৫

২০২৫ সাল যেন ফুটবল ইতিহাসের এক অলৌকিক অধ্যায়। এমনই এক বছর, যে ক্রীড়াবর্ষ অবিশ্বাস্য এক স্ক্রিপ্টে রচনা হচ্ছে। দীর্ঘদিনের হাহাকার, অপেক্ষা আর ব্যর্থতার গল্পগুলো এবার বদলে গেছে বিজয়ের গল্পে। এটি যেন এক পাণ্ডুলিপি, যেখানে বছরের পর বছর, কখনো কয়েক দশক কিংবা এক শতাব্দীরও বেশি সময় ধরে জমে থাকা অপেক্ষা, কান্না আর আক্ষেপ— সব মিলিয়ে রচিত হয়েছে ঐতিহাসিক এক মহাকাব্যে।

এই বছরে যারা শিরোপার স্বাদ পেয়েছে, তাদের মধ্যে কেউ ৭০ বছর, কেউ ৯১ বছর, আবার কেউ ৫১ বছরের শুষ্ক পথচলার পর এসে ছুঁয়েছে সেই সোনালি রৌদ্র। বলার অপেক্ষা রাখে না, ২০২৫ সালের ফুটবল যেন নিজেই প্রমাণ করেছে যে একাগ্রতা, অধ্যবসায় ও বিশ্বাস ঠিক কোথায় নিয়ে যেতে পারে কোনো মানুষ কিংবা গোটা একটা দলকে।

আরও পড়ুন: ‘সাকিবই বিশ্বের সেরা অলরাউন্ডার’, লাহোরের মালিকের কন্ঠে মুগ্ধতা 

গল্পটা বাংলাদেশের ঐতিহ্যবাহী ক্লাব মোহামেডান থেকে শুরু করাই শ্রেয়। দীর্ঘ দুই যুগের শিরোপা-হীনতা, সাংগঠনিক বিশৃঙ্খলা, এমনকি ক্যাসিনোকাণ্ডে কলঙ্কিত হওয়ার পরও উঠে দাঁড়ানোর অসাধারণ দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে মতিঝিলের ক্লাবটি। ২০০২ সালের পর প্রথমবারের মতো ঘরোয়া ফুটবলের লিগ শিরোপা, আর পেশাদার লিগে তো এটাই প্রথম জয়।

২০০৭ সালে বাংলাদেশ প্রিমিয়ার লিগ নামে যাত্রা শুরুর পর এই প্রথমবার চ্যাম্পিয়ন হলো মোহামেডান। সর্বশেষ ম্যাচে চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী আবাহনীর হারের সুবাদে তাদের কাঁধেই উঠেছে শিরোপা। আশির দশকে রাজকীয়ভাবে ফুটবলে শাসন করা দলটি যখন ২০১৯ সালে কেলেঙ্কারিতে জর্জরিত হয়ে পড়েছিল, তখনও কেউ ভাবেনি তারা আবার ঘুরে দাঁড়াবে। কিন্তু সময়ের চাকায় মোহামেডান আবারও প্রমাণ করলো— ঐতিহ্য কখনো মুছে যায় না। ফুটবল মাঠের জয়গানে তাকে ফিরতেই হবে।

এবার বাংলাদেশ ছেড়ে সূদুর ইংল্যান্ডে যাওয়া যাক।১৯০৫ সালে প্রতিষ্ঠিত ক্রিস্টাল প্যালেস ইতিহাসে কখনো বড় কোনো শিরোপাই জিততে পারেনি। লিগ টেবিলের মাঝামাঝি ঘোরাফেরা, কখনো এফএ কাপ কিংবা কারাবাও কাপেও চূড়ায় ওঠা হয়নি। সেই প্যালেসই এবারে স্তব্ধ করে দিয়েছে পেপ গার্দিওলার মহা শক্তিশালী  ম্যানচেস্টার সিটিকে। ইংলিশ ফুটবলার ইজের একমাত্র গোলে ১-০ ব্যবধানে জয়, আর তার সঙ্গে এফএ কাপের শিরোপা। একশত বিশ বছরের অপেক্ষার অবসানে অবশেষে শেষ হাসি হাসলো ‘দ্য ঈগল’ খ্যাত দক্ষিণ লন্ডনের এই ক্লাবটি!

আরও পড়ুন: ডেথ ওভারে মুস্তাফিজই ডট বলের রাজা

অবশ্য শুধু ইংল্যান্ডের ঈগলই না, চমক দেখিয়েছে নেদারল্যান্ডসের ঈগলরাও। ডাচ ফুটবলের ‘গো এহেড ঈগলস’— নামটা প্রথম শুনে অনেকেই চমকে উঠবেন। ইউরোপিয়ান ফুটবলে খুব একটা পরিচিত মুখও নয়, তবে ১৯৩৩ সালে শেষবার জাতীয় শিরোপা জেতার পর একটানা ৯১ বছরের অপেক্ষা তাদের। এই দীর্ঘ সময় পর ২০২৫ সালে তারা জিতেছে ডাচ কাপ— কেএনভিবি। ফাইনালে এজেড আইকমারকে হারিয়ে শিরোপা ছুঁয়েছে তারা, সেটাও আবার পেনাল্টি শ্যুট-আউটের উত্তেজনায় ঠাসা ম্যাচে। কী দুর্দান্ত ভাবেই না আক্ষেপ ফুরোলো অবশেষে!

এদিকে রুপকথার জন্ম দিয়েছে ইংল্যান্ডের আরেক ক্লাব নিউক্যাসেল ইউনাইটেডও। ইংলিশ ফুটবলে সমৃদ্ধ ইতিহাস থাকা ‘ম্যাগপাই’ খ্যাত এই ক্লাবটি দীর্ঘ ৭০ বছর ধরে চেয়ে ছিল ট্রফিকেসের দিকে। বহুবার সম্ভাবনা তৈরি হয়েছিল, কিন্তু শেষতক হতাশাই সঙ্গী হতো। তবে এই ২০২৫ সালে এসেই তারা ভেঙেছে এই রুদ্ধ চক্র। কারাবাও কাপের ফাইনালে তারা লিভারপুলকে ২-০ গোলে হারিয়ে জিতেছে বহু আকাঙ্ক্ষিত শিরোপা। সমর্থকদের কান্না আর উল্লাসে ডুবে যাওয়া সেই রাত যেন ছিল সাত দশকের সমস্ত কষ্টের স্রোতস্বিনী রূপান্তর।

অন্যদিকে, ইতালিয়ান ফুটবলেও ২০২৫ লিখেছে নতুন ইতিহাস। বোলোনিয়া— একসময় সিরি আ লিগে শাসন করলেও ১৯৭৪ সালের পর তাদের ট্রফিকেসে আর কোনো শিরোপা যোগ হয়নি। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের আগেও এই ক্লাবের নাম ছিল প্রতিপক্ষের গলার কাঁটা। তবে আধুনিক ফুটবলে তারা হয়ে গিয়েছিল ইতিহাসের পাতার অংশমাত্র। সেই বোলোনিয়াই আবার জেগে উঠেছে।

২০২৫ সালের কোপা ইতালিয়ার ফাইনালে তারা এসি মিলানকে ১-০ গোলে হারিয়ে উল্লাসে মাতিয়েছে শহরবাসীকে। এই জয় শুধু একটি ট্রফি নয়, এটা ছিল বিশ্বাস, লড়াই এবং ফিরে আসার গল্প।

আরও পড়ুন: পিএসএলে ফিরে উচ্ছ্বাস, ম্যাচের জন্য প্রস্তুত সাকিব

এদিকে, অবিশ্বাস্য কামব্যাকের গল্প লিখেছে সুইস ফুটবলও। ২০১৭ সালের পর অবশেষে লিগ শিরোপা জিতেছে এফসি বাসেল। যেখানে সবচেয়ে বড় অবদান রেখেছে তাদেরই ঘরের ছেলে জেরদান শাকিরি। ইউরোপের বিভিন্ন ক্লাব ঘুরে একসময় আমেরিকার ক্লাবেও খেলে এই ফুটবলার নিজের ক্যারিয়ারের সবচেয়ে দুর্দান্ত প্রত্যাবর্তনই করেছেন শেষ বয়সে এসে। এবারের সুইস লিগে সবচেয়ে বেশি ১৮ গোলের পাশাপাশি এ পর্যন্ত শাকিরি এসিস্ট করেছেন মোট ২০টি। এমন রুপকথা গোটা ইউরোপেও খুঁজে পাওয়া দুষ্কর।

অন্যদিকে, গোটা একটা ক্যারিয়ারে কখনো শিরোপার ছোঁয়া না পাওয়া অভাগা হ্যারি কেইনও এবার লিখেছে রুপকথা। ‘ট্র্যাজিক হিরো’র মতো দেখতে দেখতে একটা প্রজন্মই হ্যারি কেইনের ট্রফিশূন্য ক্যারিয়ারের গল্প শুনে বড় হয়েছে। টটেনহামের হয়ে ব্যর্থতা, জাতীয় দলের হয়ে হৃদয়ভাঙা, সব মিলিয়ে শিরোপা যেন তার কল্পনাতীত ছিল। ২০২৩ সালে বায়ার্ন মিউনিখে যোগ দিয়েও প্রথম মৌসুমে ব্যর্থ হন। কিন্তু ২০২৫ সালেই অবশেষে তিনি জিতলেন বুন্দেসলিগা। তিন দশক ধরে একটানা লড়াই করে পাওয়া এই সাফল্য হ্যারি কেইনের জন্য একটা শিরোপাই নয়, এক যুগের কষ্টের চূড়ান্ত পুরস্কার।

একদিকে ক্লাব, আরেকদিকে খেলোয়াড়— সবাই যেন ২০২৫ সালে এসে নিজেদের পুনরুজ্জীবিত করলো। বহু বছরের তৃষ্ণা শেষে তারা পেল সাফল্যের জল। এই বছরটি দেখিয়ে দিয়েছে, ‘অপেক্ষা’ শব্দটা কতটা অর্থবহ হতে পারে যদি লেগে থাকা যায়।

আরও পড়ুন: আকবরের ব্যাটে প্রত্যাবর্তনের ঝলক

এছাড়া এবারই প্রথমবারের মতো ইউরোপিয়ান ফাইনালে উঠেছে রিয়াল বেতিস, প্রথম চ্যাম্পিয়ন্স লিগ জয়ের এক পা দূরে দাঁড়িয়ে দুর্দান্ত প্যারিস সেইন্ট জার্মেইনও। এছাড়া দীর্ঘ ১৭ বছরের ট্রফির খরা কাটানোর সুযোগ থাকছে টটেনহ্যাম হটস্পারের সামনেও।

অর্থাৎ, ২০২৫ সাল তাই শুধু ফুটবল ইতিহাসে নয়, ক্রীড়া-সভ্যতার দলিল হিসেবে স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে। শিরোপা শুধু কখনো একটা ট্রফি নয়, বরং সেটি হয়ে ওঠে দল, খেলোয়াড় এবং সমর্থকদের প্রাণের অংশ। সে অংশটা ২০২৫ সালে অনেকেই ফিরে পেয়েছে— এ যেন এক ঐশ্বরিক ফুটবলের পুনর্জন্ম।

আরও পড়ুন: কাকা-ইতোদের সাথে প্রীতি ম্যাচ খেললেন তাবিথ আউয়াল

আরও খবর

একটি মন্তব্য করুন

দয়া করে আপনার মন্তব্য লিখুন
দয়া করে এখানে আপনার নাম লিখুন

সর্বশেষ খবর

জনপ্রিয় খবর