সংযুক্ত আরব আমিরাতের বিপক্ষে সিরিজ হারের পর পাকিস্তানের বিপক্ষেও প্রথম দুই ম্যাচে হেরে সিরিজে পরাজয় মেনে নিতে হয়েছে বাংলাদেশকে। এমন ধারাবাহিক হারে টি-টোয়েন্টি র্যাংকিংয়েও হয়েছে অবনতি। দলের এমন পরিস্থিতিতে বড্ড হতাশ বিসিবির ক্রিকেট অপারেশনসের চেয়ারম্যান নাজমুল আবেদিন ফাহিম। জানিয়েছেন যেই মানের ক্রিকেট বাংলাদেশ খেলছে সেটা মোটেই তাদের সাথে যায় না।
আরও পড়ুন: অভিনব পন্থায় আর্জেন্টিনার স্কোয়াড ঘোষণা, ফিরলেন মেসি
পাকিস্তানে অবস্থানরত ফাহিম সাংবাদিকদের সাথে আলাপকাপে বলেন, “সত্যি বলতে একটু হতাশ বলার সুযোগ নেই, বেশ অনেকটাই হতাশ আমি। হতাশ এই কারণে না শুধু যে আমরা ম্যাচ হেরেছি বা দুটো সিরিজ হেরেছি, হতাশ এই কারণে যে আমরা যেই মানের ক্রিকেট খেলছি তা মোটেই আমাদের সাথে যায় না। কিন্তু আমরা দেখছি ক্রমেই একটা অবনতি দেখছি, কনফিডেন্সের অভাব দেখতে পাচ্ছি। আমরা এখানে দুটো ম্যাচেই চেজ করেছি এবং দুটো ম্যাচেই আমাদেরকে দুইশো রানের মত করে চেজ করতে হয়েছে।”

“দুইশো রানের বোঝা বোঝবার মত ক্ষমতা আমাদের আছে কিনা এই একটা প্রশ্ন আমার মনে জাগে। ১৭০-১৮০ রান হলে এক ধরনের মানসিকতা থাকে চেজ করার সময়। ২০০ রান কিন্তু আজকাল মডার্ন টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটে স্বাভাবিক স্কোর এবং যে উইকেটে খেলা হচ্ছে সেখানে ২০০ রান কিন্তু হবেই। তবে সেই ২০০ রানের বোঝা বইতে হয়তো আমরা পারছি না।”
আরও পড়ুন: সৌদিতে বেনজেমার মহাকাব্য, ডাবল ট্রফিতে স্বর্ণালী প্রত্যাবর্তন
ম্যানেজমেন্ট যে পরিকল্পনা দিচ্ছে সেটা আদৌতে ক্রিকেটাররা মানতে পারছে কিনা সেটা নিয়েও সন্দেহ রয়েছে ফাহিমের মনে। তিনি বলেন, “ম্যানেজমেন্ট যেই পরিকল্পনা দিচ্ছে ব্যাটিং এর জন্য সেটার প্রয়োগ কতটা হচ্ছে সে প্রশ্নটাও আসে। কারণ প্রথম ম্যাচে আমরা দেখেছি যে আমাদের সেকেন্ড উইকেট বা থার্ড উইকেটে একটা পার্টনারশিপ হয়েছিল। কিন্তু সেফ ক্রিকেট খেলতে গিয়ে একটা পর্যায়ে গিয়ে প্রয়োজনীয় রান রেটটা এত বেড়ে যায় যেটা পরবর্তী ব্যাটসম্যানের জন্য খুবই কঠিন হয়ে যায়।”
“কিন্তু আবার দ্বিতীয় ম্যাচে দেখলাম যে তেমনটা যেন না হয় সেজন্য একটু আক্রমনাত্মক খেলতে গিয়েও সেটা ব্যর্থ হয়েছে। তাই যে পরিকল্পনাটা দেয়া হচ্ছে সেটা প্রয়োগ করতে না পারার ব্যাপারটাও বোধ হয় আছে। আমার মনে হয় যে এটা অনেক হতাশার, কারণ এটা আমরা আশা করিনি। আমাদের ধারণা ছিল যে আমরা টি-টোয়েন্টিতে অনেকের চাইতে হয়তো কিছুটা পিছিয়ে আছু। কিন্তু সেটা যে এই অবস্থায় আছে সেটা আমাদের জানা ছিলো না।”

টি-টোয়েন্টিতে উন্নতি করতে হলে ঘরোয়া ক্রিকেট থেকে ট্যালেন্ট বাছাই করতে হবে বলে মনে করেন ফাহিম। তিনি বলেন, “আমার মনে হয় যে আমরা যদি খুব ভালো করে খুঁজি আমাদের দেশেই আমরা খেলোয়াড় পাব যারা টি-টোয়েন্টি খেলতে প্রস্তুত। টি-টোয়েন্টির মানসিকতা নিয়ে ক্রিকেট খেলে সেই রিস্ক আমাদেরকে নিতে হবে। আমি মনে করি যে নির্বাচকদেরও একটু এগিয়ে আসতে হবে। যারা টিটয়েন্টি খেলতে পারে, যারা বড় শট খেলতে পারে তাদের নিতে হবে। আমরা জানি ২০০ রান করতে গেলে কিন্তু সিঙ্গেলের কাজ হয় না। ২০০ করতে গেলে কিন্তু চার-ছক্কা মারতে হবে এবং সেটা কিন্তু ম্যাচের শুরু থেকেই করতে হবে। কিন্তু আমরা আমাদের ডোমেস্টিক খেলায় যেটা অভ্যস্ত আমরা দেখি উপর থেকে একটা পার্টনারশিপের চেষ্টা হয় যেখানে হয়তো ওভারপ্রতি ছয়-সাত রান করে হয়।”
আরও পড়ুন: লাল বলের চ্যালেঞ্জ নিতে প্রস্তুত হারিস রউফ
“আমরা পাকিস্তানকে দেখছি শুরু থেকে যখনই সুযোগ পাচ্ছে ওরা চালিয়ে খেলছে, সেটা প্রথম ওভার হোক বা দ্বিতীয় ওভার হোক। সেখানে চার আসছে, ছয় আসছে। আমরা শুরু করছি সেভাবে কিন্তু তার পরে কিন্তু আমরা সে ধারাবাহিকতা রাখতে পারছি না। এর পরের ব্যাটসম্যান যারা আছে তারা হয়তো অন্যভাবে তাদের ইনিংস খেলে। এটা নিয়ে আমাদের ভাবতে হবে যে কোন ধরনের ব্যাটসম্যান আমাদের আছে যারা টি-টোয়েন্টিতে ভালো করবে তাদেরকে খুঁজে বের করা এবং তাদেরকে নিয়েই দলে প্রাধান্য দেয়ার ব্যাপারটাও আসতে পারে।”
দারুণ শুরু করেও নিজের ইনিংসটা বড় করতে পারছেন না তানজিদ তামিম। তামিমকে বেশ স্কিলফুল খেলোয়াড় মানলেও তার মধ্যে চিন্তাভাবনার ঘাটতি দেখছেন ফাহিম। তিনি জানান, “তামিমের ব্যাপারটা খুবই দুঃখজনক কারণ আমি ব্যক্তিগতভাবে মনে করি খুবই স্কিলফুল একজন খেলোয়াড়। কিন্তু আমার মনে হয় যে স্কিলফুল হওয়া এক জিনিস আর ব্যাটিং আরেক জিনিস। একটা ইনিংসে বিভিন্ন সময়ে যে ব্যাটিংটাকে গোছাতে হয় সেই জায়গাটাই বোধয় ওর চিন্তাভাবনার মধ্যে কিছুটা ঘাটতি আছে। আমি পুরো সময়টা জুড়েই আক্রমণাত্মক খেলতে পারবো না। কোন না কোন সময় আমার ভুল হবেই। তো সেই জায়গায় আমাকে একটু সাবধান হতে হবে। ১৮০ হলে হয়তো আমরা কমফর্টেবল ফিল করতাম।”

“শুরুতে আমরা বেশ ভালো শুরু করছিলাম। তখন আমাদের প্ল্যানটা উচিত ছিল যে না এখন আমাদের জিনিসটা আমাদের কন্ট্রোলে আছে। আমরাও একটু কন্ট্রোলে খেলার চেষ্টা করি। খেলাটাকে একটু গুছিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করি। এইযে এই এডাপ্টেশনটা একটা খেলোয়াড়ের খুব জরুরি যে আমরা কখন খুব এগ্রেসিভ খেলবো, কখন পার্টনারশিপটা ডেভেলপ করার চিন্তাভাবনা করতে হবে। আমার মনে হয় এই জায়গা গুলিতে আমাদের ঘাটতি আছে যে একটা টিমের কি প্রয়োজন এবং প্রয়োজন অনুযায়ী খেলাটা কিভাবে খেলা উচিত সে জায়গাটা বোঝা।”
আরও পড়ুন: ‘বাংলাদেশ আমার আত্মার ঠিকানা’ — শমিতের হৃদয় ছোঁয়া বার্তা
হৃদয়ের বাজে ফর্ম নিয়েও শঙ্কিত ফাহিম। এ ব্যাপারে তিনি বলেন, “ভাবাচ্ছে না বললে ভুল হবে। ওকে হয়তো আমরা মনে করি মিডিল অর্ডার একজন ব্যাটসম্যান যে আক্রমণাত্মক ক্রিকেট খেলতে পারে ও বড় শট খেলার মানসিকতা রয়েছে। যদিও ওর আকৃতি অনেক বড় না কিন্তু বড় শট খেলার যোগ্যতা আছে, ক্ষমতা আছে। কিন্তু আমি জানিনা ব্যাটিং প্ল্যানগুলো এখন কেমন, ওর সাথে কি ধরনের আলাপ আলোচনা হচ্ছে। ওর ব্যাটিং করার মানসিকতার মধ্যে কিছুটা বিপর্যয় দেখছি। আমি নিশ্চিত যে টিম ম্যানেজমেন্ট সেগুলো দেখছে এবং তারা এগুলো নিয়ে কাজ করবে।”

অধিনায়ক হিসেবে লিটন দাসকেই সেরা অপশন ভাবছেন ফাহিম। তবে তার কাছ থেকে আরো ভালো ব্যাটিংয়ের আশা করেন এই পরিচালক। তিনি জানান, “ক্যাপ্টেনসি আমার মনে হয় ঠিক আছে কারণ আমাদের রিসোর্স খুব বেশি থাকে না। বিশেষ করে ফিল্ডিং এর সময় পাঁচজন বোলার নিয়ে আমরা আমরা খেলতে নামি এবং থ্যাংকফুলি আমরা বোধহয় একটা এই সিরিজে একটা ভালো জিনিস আবিষ্কার করেছি সেটা হচ্ছে শামিমের বোলিং। এটা আমাদেরকে ভবিষ্যতে দারুণভাবে দল গোছাতে সাহায্য করবে। সেই দিকে যদি বিবেচনা করি আমাদের ক্যাপ্টেনসিটা ভালো হচ্ছে। তবে ওর কাছ থেকে ব্যাটিংটা আমি আরো অনেক ভালো ব্যাটিং আশা করি।”
আরও পড়ুন: রিয়ালের ইতিহাসের পাতায় ইতি টানছেন লুকা মদ্রিচ
ক্রিকেটের সার্বিক উন্নয়নের জন্য ঘরোয়া ক্রিকেটের দিকে আরো মনোযোগী হবার পরামর্শ ফাহিমের। তিনি বলেন, “আমরা যদি ২০১৫ সালের কথা ভাবি সেসময় আমাদের ক্রিকেট যে অবস্থায় ছিল সেখান থেকে আমরা কতটুকু পিছিয়ে গেছি এটা আমরা যদি একটু হিসাব করি তাতে বোঝা যায়। পেছানোর তো কথা ছিল না। আমরা সবসময় বলে এসছি যে ঘরোয়া ক্রিকেটটাকে আরো উন্নত করতে হবে, ওখানে আরো মনোযোগ দিতে হবে, ওখানে কম্পিটিটিভ এনভারনমেন্ট তৈরি করতে হবে, তাহলে হয়তো আমরা আরো ভালো খেলো নিয়ে আসতে পারবো। কিন্তু সেটা তো হয়নি বরং আমাদের যে কালচারটা ভালো প্লেয়ার গড়ে তুলে সেই কালচারটাকে আমরা ধীরে ধীরে নষ্ট করেছি।”

এছাড়া জাতীয় দল থেকে শুরু করে ক্রিকেট বোর্ড সব জায়গায় জবাবদিহিতার ব্যাপার নিয়ে আসার পক্ষে মত ফাহিমের। তিনি জানান, “খেলার প্রত্যেকটা সেক্টরে যদি আমরা একটু ইমপ্রুভমেন্টের চেষ্টা করি, একটু ভালো উইকেট, আর দুটো বেশি মাঠ, কোচ যারা আছে তাদেরকে একটু শিক্ষিত করা, ভালো ইকুইপমেন্ট দেওয়া, ভালো ট্রেনিং প্রোগ্রাম রান করা এবং সেটা ভালোভাবে মনিটর করা, জবাবদিহিতার ব্যাপার থাকতে হবে। প্রত্যেকের জবাবদিহিতা থাকতে হবে। তারপর আমাদের তো আছেই। সো প্রত্যেকের জবাবদিহিতা থাকতে হবে। কারণ আজকে যে বাংলাদেশ দল যেই খেলাটা খেলছে এর দায় কিন্তু আমাদেরকেই নিতেই হবে। সো ওই জবাবদিহিতার জায়গাটাও সবার পরিষ্কার থাকতে হবে।”