বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডের নেতৃত্বে পরিবর্তনের আলোচনা গত কয়েকদিনে অনেকটা গতি পেয়েছিল। সরকারের পক্ষ থেকে নতুন সভাপতির বিষয়ে চিন্তা-ভাবনা চলছিল এবং আলোচনায় উঠে আসে জাতীয় দলের সাবেক অধিনায়ক আমিনুল ইসলাম বুলবুলের নাম। তবে এই প্রক্রিয়া আপাতত জটিল হয়ে উঠেছে, কারণ জাতীয় দৈনিক প্রথম আলো কে বর্তমান সভাপতি ফারুক আহমেদ জানিয়েছেন, তিনি স্বেচ্ছায় পদত্যাগ করবেন না।
যুব ও ক্রীড়া উপদেষ্টা সম্প্রতি ফারুক আহমেদকে মৌখিকভাবে জানিয়েছেন, সরকার বিসিবির নেতৃত্বে পরিবর্তন চায়। বিষয়টি জানতে পেরে ফারুক দু-একদিন সময় নিয়ে চিন্তা করার ইচ্ছা প্রকাশ করেন। কিন্তু ২৯ মে প্রথম আলো কে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে তিনি স্পষ্ট করেছেন, কোনো কারণ ছাড়া তিনি স্বেচ্ছায় পদত্যাগ করবেন না। তাঁর ভাষায়, “আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছি পদত্যাগ করব না। আমাকে বলা হয়েছে, সরকার নাকি আমাকে আর বিসিবি সভাপতি হিসেবে রাখতে চাচ্ছে না। কিন্তু কেন রাখতে চাচ্ছে না, সেটার কোনো কারণ তাঁরা আমাকে বলেনি। বিনা কারণে তো আমি পদত্যাগ করতে পারি না।”

আরও পড়ুন: ফারুকের স্থলাভিষিক্ত হতে পারেন বুলবুল
এ ধরনের অবস্থান বিসিবি সংবিধান অনুসারে তাঁর অধিকার। যেহেতু সভাপতি নির্বাচন হয় বোর্ডের ভোটের মাধ্যমে, তাই তাঁকে অপসারণ করতে হলে আনুষ্ঠানিক বোর্ড সভায় দুই-তৃতীয়াংশ সদস্যের সমর্থন প্রয়োজন হবে। অন্যদিকে, সরকার যদি সরাসরি কাউকে চাপ প্রয়োগ করে পদত্যাগে বাধ্য করে, তাহলে সেটা আন্তর্জাতিক ক্রিকেট সংস্থা আইসিসির কাছে সরকারি হস্তক্ষেপ হিসেবে বিবেচিত হতে পারে।এই কারণেই মূল পরিকল্পনা ছিল ফারুক আহমেদের ‘স্বেচ্ছায়’ সরে দাঁড়ানো—যাতে বোর্ডের স্বাভাবিক প্রক্রিয়া বজায় থাকে এবং কোনো নিষেধাজ্ঞার ঝুঁকি না থাকে। কিন্তু এখন যেহেতু তিনি পদ ছাড়ছেন না, পরিবর্তনের প্রক্রিয়া অনিশ্চয়তার মুখে পড়েছে।
এই পটভূমিতে সবচেয়ে আলোচিত নাম হচ্ছে আমিনুল ইসলাম বুলবুল। বাংলাদেশের প্রথম টেস্ট অধিনায়ক হিসেবে তিনি দেশের ক্রিকেট ইতিহাসে এক গুরুত্বপূর্ণ নাম। খেলা ছাড়ার পর বুলবুল অনেকদিন ধরেই আইসিসি ও এসিসির উন্নয়ন কর্মকাণ্ডে জড়িত। বর্তমানে তিনি এসিসির হাই পারফরম্যান্স কমিটির সদস্য এবং আইসিসির গ্লোবাল ডেভেলপমেন্ট প্যানেলের গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বে আছেন। তাঁর দীর্ঘ প্রশাসনিক অভিজ্ঞতা এবং আন্তর্জাতিক সংস্থার সঙ্গে সম্পৃক্ততা তাঁকে বিসিবির নেতৃত্বে একটি গ্রহণযোগ্য মুখ হিসেবে প্রতিষ্ঠা করেছে। শুধু প্রাক্তন ক্রিকেটার হিসেবেই নয়, বরং আন্তর্জাতিক ক্রিকেট প্রশাসনে সক্রিয় একজন পেশাদার হিসেবেই তাঁর নাম বিবেচনায় এসেছে। এই প্রথম তাঁকে সরাসরি বোর্ডের উচ্চপর্যায়ের কোনো আলোচনায় আনা হলো। এর আগে অনেক সময় তাঁকে বোর্ডের বাইরে রাখা হয়েছিল, যদিও তিনি বহুবার দেশে ফিরে বিসিবিতে অবদান রাখার আগ্রহ প্রকাশ করেছিলেন। এবারের প্রস্তাব নিয়ে তাঁর অবস্থান ছিল স্পষ্ট—দেশের প্রয়োজনেই তিনি দায়িত্ব নিতে প্রস্তুত, ব্যক্তিগত উচ্চাকাঙ্ক্ষা তাঁর মূল লক্ষ্য নয়।

আরও পড়ুন: হেসনের পর সালমানও মুগ্ধ বাংলাদেশের পেস আক্রমণে
তবে পুরো প্রক্রিয়া এখন একটি প্রশ্নবোধক চিহ্নের মুখে। অনেকেই মনে করছেন, সরকারের ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও যদি সভাপতি পরিবর্তনের প্রক্রিয়া আটকে যায়, তাহলে বিষয়টি শুধু অভ্যন্তরীণ নয়, আন্তর্জাতিক পর্যায়েও প্রতিক্রিয়া তৈরি করতে পারে। এর আগে শ্রীলঙ্কা ক্রিকেট বোর্ডের উপর তাদের সরকার হস্তক্ষেপ করায় ক্রিকেট থেকে সাময়িকভাবে নিষিদ্ধ হয়েছিলো শ্রীলঙ্কা। ফারুক আহমেদের পক্ষ নিয়ে জাতীয় দলের এক সাবেক অধিনায়ক প্রথম আলোকে বলেন, “বাংলাদেশের ক্রিকেট নিয়ে এভাবে সিদ্ধান্ত নেওয়া উচিত নয়। আজ একজনকে বসালাম, কাল সরিয়ে দিলাম—এটা হলে আন্তর্জাতিক অঙ্গনেও প্রশ্ন উঠবে।” তাছাড়া প্রথম আলোকে এক ক্রিকেটার বলেছেন, ‘তিনি তো নিজ থেকে বোর্ডে আসতে চাননি। তাঁকে সরকারই ডেকে এনে বোর্ডে বসিয়েছে। এখন তিনি কি এমন করলেন যে সরকার তাকে চাচ্ছে না!’

আরও পড়ুন: পৃথিবীর যেকোনো দলকে হারাতে পারে বাংলাদেশ: লিটন
এই মুহূর্তে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে বোর্ড এবং সরকারের মধ্যে সুসমন্বয়, এবং একজন যোগ্য নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠার পথ খোঁজা। আমিনুল ইসলাম বুলবুল যেহেতু আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত, তাই তাঁকে নেতৃত্বে আনলে তা শুধু দেশীয়ভাবে নয়, আন্তর্জাতিক পরিসরেও একটি ইতিবাচক বার্তা দেবে। তবে তা সম্ভব হবে তখনই, যখন বর্তমান সভাপতি নিজ থেকেই একটি দায়িত্বশীল সিদ্ধান্ত নেবেন, অথবা বোর্ডের নিয়মতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় পরিবর্তন সম্ভব হবে। অন্যথায় এই উদ্যোগ আটকে যেতে পারে বোর্ড সংবিধানের জটিলতায়।
সবমিলিয়ে বলা যায়, দেশের ক্রিকেট এখন একটি গুরুত্বপূর্ণ সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে। নেতৃত্বের পরিবর্তন শুধু একজন ব্যক্তির চলে যাওয়া বা আসা নয়, বরং তা দেশের ক্রিকেটের ভবিষ্যৎ পথচলার দিক নির্ধারণ করবে। এখন অপেক্ষা—এই পথচলায় কী বুলবুল আসবেন সামনে, নাকি পরিস্থিতি থেকে যাবে স্থবির।