জোসেফ এডওয়ার্ড রুট, সংক্ষেপে জো রুট। ইংল্যান্ডের এই প্রজন্মে টেস্টের রাজপুত্র বলে খ্যাত, কিন্তু একদিনের ক্রিকেটে কী তিনি এখনও অপরিহার্য? প্রশ্নটা বারবার উঠেছে গত ক’বছর ধরে। নতুন যুগে ওয়ানডেতে চড়া স্ট্রাইক রেট, ৩৬০ ডিগ্রি শট, পাওয়ার হিটিংয়ের জোয়ারে অনেকেই ভেবেছিলেন— জো রুট বুঝি একটু ‘আউটডেটেড’। কিন্তু কার্ডিফে ৩০৮ রানের বিশাল পাহাড়ের সামনে দাঁড়িয়ে রুট যেন একাই বলে দিলেন— ‘এই ফরম্যাটে আমিও এখনো এক রাজার মতো দাঁড়িয়ে আছি।’ লাল বল থেকে সাদা বলের ফরম্যাটেও আমি জানি কিভাবে মহাকাব্য লিখতে হয়।
৩০৯ রানের পাহাড়সম টার্গেটের সামনে ব্যাটিংয়ে নেমে ইনিংসের প্রথম ওভারেই উইকেট হারায় ইংল্যান্ড। পরের ওভারে আবারও ছন্দপতন। জেমি স্মিথ ও বেন ডাকেট, দুই ওপেনারই ফিরেছেন শূন্য রানে। এমন শুরুর পর যেকোনো দলের জন্য ম্যাচে ফেরাটা দুরূহ।

কিন্তু উইকেটের অপর প্রান্তে দাঁড়িয়ে থাকা রুট জানতেন, এখন তাকে শুধু ইনিংস গড়তে হবে না— একটি বার্তা দিতেও হবে। ক্রিকেটবিশ্বকে বোঝাতে হবে, তিনি এখনো দলকে জেতাতে পারেন। এখনো ওয়ানডে ফরম্যাটেও ব্যাট হাতে ছড়ি ঘুরিয়ে জানাতে পারেন, এই ফরম্যাটেও তিনি কম যান না।
আরও পড়ুন: শ্রেয়াস আইয়ার: তিন ফ্র্যাঞ্চাইজিকে ফাইনালে নেওয়া অধিনায়ক
তার ইনিংসটা ছিল যেমন স্থির, তেমনি মগ্ন। ফ্লিক, স্কয়ার কাট, ব্যাকফুট পাঞ্চ— যেকোনো শটে ক্লাসের ছাপ ছিল। ব্যাটিংয়ের একেকটা মুহূর্তে বোঝা যাচ্ছিল, অভিজ্ঞতা কাকে বলে। তার ব্যাটে কোনো তড়িঘড়ি নেই, ছিল শৃঙ্খলা, ছিল পরিকল্পনা। শুরুতে স্ট্রাইক ধরে রাখলেন, তারপর ধীরে ধীরে ছন্দে এলেন। ম্যাচের গতিপথ বদলে দিলেন নিজের মতো করে।
একটা সময় মাত্র ২ রানে ২ উইকেট থেকে ৯৩ রানে নেই ৪ উইকেট। সেই ম্যাচই ইংল্যান্ড জিতলো ৭ বল বাকি থাকতেই, হাতে ৩ উইকেট রেখে। রুটের অনবদ্য ইনিংসটি নিছক একটা শতক নয়— এটা ছিল চরিত্রের, মানসিকতার, ক্রিকেটবোধের মূর্ত প্রতিফলন। আর এই ইনিংসেই তিনি পেরিয়ে গেলেন ৭ হাজার ওয়ানডে রানের মাইলফলক, ইংল্যান্ডের ইতিহাসে এই ফরম্যাটে যেটা কেউ করতে পারেননি। সঙ্গী ব্রুক বা লিভিংস্টোন হোক, অথবা শেষদিকে উইকেটপতনের মাঝে একার লড়াই— জো রুট ছিলেন নির্ভরতার আরেক নাম।

১৩৯ বলে ২১টি চার ও ২ ছক্কায় সাজানো ১৬৬ রানের ইনিংসে অপরাজিত থেকেই ম্যাচ শেষ করলেন তিনি। ওডিআই ক্যারিয়ারে এটিই তার সেরা ইনিংস। আর এই ইনিংসের মাধ্যমেই হয়তো তিনি আবারও লিখে দিলেন, কেন তাকে ‘আধুনিক সময়ের ক্লাসিক’ বলা হয়। ইংল্যান্ডের বিশ্বকাপজয়ী অধিনায়ককে টপকে ওয়ানডে ক্যারিয়ারের ১৮তম সেঞ্চুরিতে জো রুট যেনো ছাড়িয়ে গেলেন নিজেকেই।
আরও পড়ুন: ওডিয়াই ক্রিকেটকে বিদায় জানালেন ম্যাক্সওয়েল
তবে এই ম্যাচে কিন্তু রুট একাই আলো কাড়েননি। ওয়েস্ট ইন্ডিজের ইনিংসে, তার আগেই জ্বলে উঠেছিল আরেক নক্ষত্র— কিসি কার্টি। ছোট্ট একটা দ্বীপ সেন্ট মার্টিন থেকে উঠে আসা এই তরুণ, আজ ওয়েস্ট ইন্ডিজের অন্যতম আলোচিত নাম।
কার্টির ইনিংসটা ছিল ঠিক যেন আধুনিক ওয়েস্ট ইন্ডিজ ব্যাটিংয়ের বিপরীতে এক বিপ্লব। যেখানে চার-ছয়ের বন্যা নয়, ছিল গঠনমূলক খেলা, শট বাছাইয়ের পরিপক্বতা আর ইনিংস গড়ার সচেতন প্রয়াস। এমন পরিণত ইনিংস একটা তরুণ ব্যাটারের কাছ থেকে পাওয়া যায় না সহজে, বিশেষ করে ইংলিশ কন্ডিশনে।

১০৫ বলে ১০৩ রানের ইনিংসে ছিল ১৩টি চার, তবে ছিল না কোনো ছক্কা। উইকেটের চারপাশে খেলা শটগুলো ছিল দৃষ্টিনন্দন, এবং কার্যকর। তবে শুধু ইনিংসের সৌন্দর্য নয়, পরিসংখ্যানও বলে দিচ্ছে, কার্টি ওয়েস্ট ইন্ডিজের ভবিষ্যৎ। ওয়ানডে ক্যারিয়ারের প্রথম ৩৩ ইনিংসে তার সংগ্রহ ১,৪০৩ রান— যেটা ভিভ রিচার্ডসের থেকেও বেশি। কিংবদন্তির রেকর্ড ছাপিয়ে যাওয়া এ যুগের একজনের জন্য বিশাল কিছু।
আরও পড়ুন: হোয়াইটওয়াশ হওয়ার পরও ওপেনিং জুটি নিয়ে ইতিবাচক সিমন্স
ওয়ানডেতে নিজের শেষ চার ইনিংসেই ৩ সেঞ্চুরি হাঁকানো কার্টি যেনো ক্যারিবিয়ানদের জানালেন, এই ফরম্যাটেও তাদের ভবিষ্যৎ এখনো উজ্জ্বল। ওয়েস্ট ইন্ডিজ বহুদিন ধরেই খুঁজছে এমন একজন ব্যাটার— যিনি শুধু ধ্বংসাত্মক হবেন না, বরং ইনিংসের স্থপতি হবেন। কার্টির ইনিংসে সেই প্রতিচ্ছবিই দেখা গেল।
এই ম্যাচটা তাই হয়ে উঠল দুই মেরুর দুই নায়কের গল্প। যদিও একজন হয়ে গেলেন অমর, আরেকজন ট্র্যাজিক নায়ক। একজন অভিজ্ঞতা আর ক্লাসে পূর্ণ, যিনি বারবার প্রমাণ করেন নিজের অপরিহার্যতা। আর অন্যজন নতুন, সম্ভাবনায় টইটম্বুর, যে শিখছে, গড়ছে, এবং সামনে তাকাচ্ছে।

রুটের ইনিংস দেখাল— অভিজ্ঞতা কিভাবে ধ্বংসস্তূপের মধ্যেও গড়ে তোলে দুর্গ। আর কার্টির ইনিংস দেখাল— আস্থার জায়গা তৈরি করতে সময় লাগে না, লাগে সাহস আর নির্ভরতা। এই দুই ইনিংস যেন দুই ধরণের ক্রিকেট দর্শনের প্রতিনিধিত্ব করল।
রুটের জন্য এটা ছিল পুনর্জন্মের এক ঘোষণা— তিনি এখনো ওয়ানডেতে ম্যাচ জেতাতে পারেন। আর কার্টির জন্য এটা ছিল— ‘আমি আসছি’ বলে কাঁপিয়ে দেওয়ার মুহূর্ত।
আরও পড়ুন: হারিসের ঝড়ো সেঞ্চুরিতে পাকিস্তানে হোয়াইটওয়াশ বাংলাদেশ
হ্যাঁ, ইংল্যান্ড ম্যাচটা জিতেছে। ৩০৯ রান তাড়া করে ৩ উইকেট হাতে রেখে জয়ের জন্য রুট যে ইনিংসটা খেললেন, তাতে জয় অবশ্যম্ভাবী ছিল। কিন্তু এই ম্যাচ শুধু জয়-পরাজয়ের গল্প নয়— এটা ছিল মেধা ও মননের লড়াই। আর তার মধ্যেই দুই ব্যাটার আমাদের উপহার দিলেন এক নতুন রূপকথা।

ক্রিকেটে কত ম্যাচই তো হয়, কিন্তু এমন ম্যাচ হয় না বারবার— যেখানে একই দিনে একজন কিংবদন্তি নিজের অস্তিত্বকে আবার চিৎকার করে জানান দেন, আর অন্যদিকে এক তরুণ নিজের স্বপ্নের শুরুটা করে দেন মহাকাব্যিকভাবে।
একদিকে রুট বলছেন, “আমি এখনো রাজা”, অন্যদিকে কার্টি ফিসফিস করে বলছেন, “একদিন আমিও হবো তা।”
আরও পড়ুন: কিউবা জানালেন, “বাংলাদেশের জার্সিতে দেখা হবে মাঠে”