দীর্ঘ ১৮ বছরের আক্ষেপ, চীনের হোয়াংহো নদীর মতোই বয়ে চলছিল এক স্বপ্নভঙ্গের স্রোত— একটির পর একটি মৌসুম, প্রতিবারই যেন আইপিএল ট্রফির নাগাল পেতে গিয়েও ছোঁয়া হয়নি তা। ভিরাট কোহলির জীবনে আইপিএলের শিরোপা ঠিক যেন চীনের দুঃখ হোয়াংহোর মতোই ছিল।
তবে অবশেষে সেই আক্ষেপ ঘুচলো। আইপিএলের ১৮ তম মৌসুমে এসে অধরা স্বপ্ন ধরা দিলো কোহলির। আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে যার আর কিছুই ছিল না বাকি, ফ্র্যাঞ্চাইজি ক্রিকেটে এই একটা শিরোপার আক্ষেপেই এতদিন পুড়ছিলেন তিনি। আর দীর্ঘ সময় পর অবশেষে যখন তা নিশ্চিত হলো, সেই মুহূর্তে ভিরাট কোহলি ছিলেন যেন এক আবেগভরা কিশোর।

আরও পড়ুন: অবশেষে আইপিএলের চ্যাম্পিয়ন কোহলির বেঙ্গালুরু
মাঠে হাঁটু গেড়ে বসে পড়া, মুখ ঢেকে ফেলা— সব মিলিয়ে ১৮ বছরের অপেক্ষা যেন মুহূর্তেই তার বুকের ভেতরে জমে থাকা পাহাড়টাকে চূর্ণ করে দিলো। যদিও কেউ একবারও ভাবেনি যে কোহলি এই জয় দেখে একটুও শান্ত থাকবেন।
এই দীর্ঘ সফরে তিনবার ফাইনালে উঠেও ফিরতে হয়েছে খালি হাতে— ২০০৯, ২০১১, ২০১৬। কখনো ডেকান-চেন্নাইয়ের ধাক্কায় স্বপ্ন থেমে গেছে, কখনো সানরাইজার্সের কপালে উঠে গেছে বিজয়ের মালা। এত কাছে গিয়েও ফিরে আসার যন্ত্রণা জানে শুধু একজনই— যিনি বছরের পর বছর নিজের সবটুকু উজাড় করে দিয়েছেন সেই ট্রফির জন্য, যার জন্য তাকে এতদিন হাঁটতে হয়েছে কঠিন এক পথে। ২০১৬ সালে এক আসরেই তো করেছিলেন ৯৭৩ রান, তবুও ভিরাটের কান্না দিয়েই শেষ হয়েছিল আইপিএলের সেই আসর।
এই প্রতিযোগিতার ইতিহাসে মাত্র কয়েকজন ক্রিকেটার আছেন, যারা শুরু থেকে একটি দলের হয়ে থেকেছেন। কিন্তু ভিরাট কোহলি শুধু ছিলেন না, তিনি বেঙ্গালুরুর আত্মা হয়ে উঠেছিলেন। শুরুটা ২০০৮ সালে, একজন তরুণ ব্যাটার হিসেবে। এরপর সময়ের স্রোতে ভারতীয় ক্রিকেটের সবচেয়ে পরিশ্রমী ও আত্মবিশ্বাসী মুখ হয়ে ওঠেন। প্রতিটা মৌসুমে, প্রতিটা ম্যাচে যেন নতুন করে নিজের সীমা ভাঙার চেষ্টা করেছেন।

আরও পড়ুন: পাঞ্জাবকে উড়িয়ে দিয়ে আইপিএলের ফাইনালে বেঙ্গালুরু
ট্রফি হাতে নিয়ে বললেন, “এই জয় দলের জন্য যতটা, সমর্থকদের জন্যও ততটাই। আমি জানি, তারা কীভাবে প্রতিবার আমাদের সঙ্গে থেকেছেন। মাঠে, ঘরে, পর্দার সামনে— সবখানে। আমার জন্য এটা শুধু ট্রফি না, একটা বিশ্বাসের জয়।” কথাগুলো যেন থেমে থাকা একটা সময়কে আবার চালু করে দিলো।
তাঁর প্রতি সমর্থকদের ভালোবাসা বরাবরই ছিল সীমাহীন। প্রতিবারই যখন বেঙ্গালুরু হেরে যেত, তখন অনেকেই দল বদলাত, সমালোচনা করত। কিন্তু কোহলির দিকে তাকিয়ে সমর্থকরা খুঁজে পেতেন আত্মত্যাগের এক নিরেট প্রতিমূর্তি। যিনি দলের ডুবেও নিজে পুরোপুরি ডুবে যান না— বরং উঠে দাঁড়াতে শিখিয়ে যান।
চ্যাম্পিয়ন হওয়া ম্যাচে ব্যাট হাতে দলের পক্ষে সর্বোচ্চ ৪৩ রান কোহলিই করেছিলেন। যেমনটা গোটা মৌসুমে তিনি ছিলেন বেঙ্গালুরুর প্রাণভোমরা। ৬৫৭ রান করে ফর্মে থাকা তরুণদের পাশে দাঁড়িয়েছেন ব্যাট হাতে, আবার ফিল্ডিংয়েও লড়েছেন আগের মতোই আগ্রাসী ভঙ্গিতে। অধিনায়ক না হয়েও দল যেন তাকে একজন নায়ক হিসেবে দেখেছে। হয়তো নেতৃত্ব ছেড়েছেন, কিন্তু দায়িত্ববোধ এক বিন্দুও কমেনি।

তাঁর সাবেক সতীর্থ এবি ডি ভিলিয়ার্স যখন তাকে জড়িয়ে ধরলেন, সেই মুহূর্তটা যেন কোহলির জীবনের অন্যতম মোড় ঘুরিয়ে দেওয়া দৃশ্য। বহু বছর একই সঙ্গে কাটানো এই দুই কিংবদন্তির ভালোবাসা আর শ্রদ্ধাবোধ মিলেই তৈরি করেছে আইপিএলের সবচেয়ে সুন্দর অধ্যায়। তবে এদিন ডি ভিলিয়ার্সের পাশাপাশি মাঠে এসেছিলেন ক্রিস গেইলও। লম্বা একটা সময় এই তিনজনই বেঙ্গালুরুকে শিরোপা জেতার স্বপ্ন দেখিয়ে এসেছেন।
আরও পড়ুন: কার্ডিফে রুটের মহাকাব্য, ভিভকে ছাড়িয়ে কেসির কীর্তি
বেঙ্গালুরুর প্রতি কোহলির ভালোবাসা নিঃস্বার্থ। বহুবার সুযোগ এসেছিল ফ্র্যাঞ্চাইজি বদলে দেওয়ার, বড় অর্থে চুক্তিবদ্ধ হওয়ার। কিন্তু কোহলি থেকে গেছেন, কারণ এই দলই ছিল তাঁর ‘আত্মপরিচয়’। “অনেকেই বলেছিল, তুমি অন্য দলে গেলে ট্রফি জিতে যেতে। আমি বলেছি— ট্রফি পেলেও যদি নিজেকে হারিয়ে ফেলি, সেই জয় আমার না।” কোহলির কণ্ঠে এমনই ছিল আত্মবিশ্বাস আর আত্মসম্মানের মিশেল।

ক্রিকেটারদের ক্যারিয়ারে অনেক ধরনের অর্জন আসে— ট্রফি, রেকর্ড, খ্যাতি। কিন্তু কিছু অর্জন শুধুই হৃদয়ের। এই আইপিএল ট্রফিটা কোহলির কাছে তেমনই— যে ট্রফি স্রেফ জয়ের প্রতীক নয়, এটা তার ১৮ বছরের ঘাম, রক্ত, কান্না, ভালোবাসা আর বিশ্বাসের প্রতিদান।
অবশ্য আইপিএলের সোনালি আলোতেও কোহলি ভুলে যাননি তাঁর আসল প্রেম— টেস্ট ক্রিকেট। বললেন, “আইপিএল হৃদয়ের কাছাকাছি, কিন্তু টেস্ট ক্রিকেট আত্মার। সত্যিকারের সম্মান চাইলে লাল বলের ক্রিকেটে পারফর্ম করো। কারণ এখানেই তোমার প্রকৃত মান প্রকাশ পায়।”
আজ কোহলি হাসছেন, কিন্তু এই হাসির পেছনে হাজারো ব্যর্থতা, হাজারো রাতের নিঃশব্দ কান্না লুকিয়ে আছে। সেইসব দিন, যখন ফাইনালে হেরে পুরো দল ড্রেসিংরুমে স্তব্ধ হয়ে বসে থাকত, তখন তিনি সবার আগে উঠে বলতেন— “পরের বছর দেখা হবে।” আজ আর বলতে হচ্ছে না। আজ তাঁর চোখ বলছে— শেষ পর্যন্ত আমরাও পেরেছি।
আরও পড়ুন: কোহলিকে শুভেচ্ছা জানালেন হ্যারি কেইন

শিশুর মতো হেসে ট্রফির পাশে বসে থাকা কোহলি যেন বলে দিচ্ছেন— আশা হারানো যাবে না, স্বপ্ন দেখাও থামানো যাবে না। কোনো একদিন, কোনো এক রাতে, সেই স্বপ্ন সত্যি হবেই। আহমেদাবাদের আলো ঝলমলে রাতটা ছিল ঠিক তেমনই— যেখানে কোহলির দীর্ঘ অপেক্ষার শেষ হলো, যেখানে একটুকরো ট্রফির সঙ্গে জয় পেলো ক্রিকেটের প্রতি এক জীবনের প্রেম।