বৃহস্পতিবার, জুন ২৬, ২০২৫
সামি'স কর্নার

অন্ধকার থেকে আলোয় কী ফিরতে পারবেন রাবাদা?

কাগিসো রাবাদা— দক্ষিণ আফ্রিকান পেস বোলিংয়ের অন্যতম ভরসা। যিনি গত এক দশকে বিশ্বের সেরা ব্যাটারদের জন্য হয়ে উঠেছেন এক দুঃস্বপ্নের নাম।

গতিময়, আগ্রাসী, নিখুঁত লাইন-লেন্থে বল করতে পারা এই পেসার বিশ্বজুড়ে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছেন একজন পরিপূর্ণ বোলার হিসেবে। তবে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে জীবনের গতিপথেও আসে বাঁক। ২০২৫ সালের আইপিএল তাই রাবাদার জীবনে যেন সেই অপ্রত্যাশিত বাঁক হয়ে উঠল, যেখানে তার ক্যারিয়ারের সবচেয়ে দুঃখজনক অধ্যায়ের সূচনা ঘটেছে।

আরও পড়ুনঃ পেসারদের রহস্যময় এক অস্ত্র : দ্যা ওবোল সিম ডেলিভারি

গত ৩ এপ্রিল হঠাৎ করেই গুজরাট টাইটানসের ক্যাম্প থেকে নিজ দেশে ফিরে যান রাবাদা। সেসময় জানানো হয়েছিল, তিনি ‘ব্যক্তিগত কারণে’ ভারত ছেড়েছেন। গুজরাট টাইটানসের বিবৃতিতে সেই ‘ব্যক্তিগত কারণ’কে ঘিরে তৈরি হয়েছিল অসংখ্য প্রশ্ন। কেউ বলেছিলেন, হয়তো পারিবারিক কোনো সমস্যা, কেউ বলেছিলেন মানসিক অবসাদ। কিন্তু পরবর্তীতে যা সামনে এল, তা গোটা ক্রিকেটবিশ্বকেই হতবাক করে দিল।

ক্রিকেটের জনপ্রিয় ওয়েবসাইট ইএসপিএন ক্রিকইনফো নিশ্চিত করেছে, রাবাদা ডোপ টেস্টে ব্যর্থ হয়েছেন। এসএ টি-টোয়েন্টি লিগে এমআই কেপটাউনের হয়ে খেলার সময় তার শরীরে পাওয়া গেছে নিষিদ্ধ এক নেশাজাতীয় পদার্থের উপস্থিতি। তবে এটি কোনো পারফরম্যান্স বর্ধক নয়, বরং একটি ‘রিক্রিয়েশনাল’ ড্রাগ— বলা যায় যার ব্যবহার ক্রীড়ানীতির পরিপন্থী। তখনো বিষয়টি গোপন থাকলেও, সময়ের ব্যবধানে অবশেষে নিজের মুখেই সব স্বীকার করে নিয়েছেন এই প্রোটিয়া পেসার।

এক বিবৃতিতে রাবাদা বলেন, “আমি সম্প্রতি ব্যক্তিগত কারণে আইপিএল থেকে দেশে ফিরেছিলাম। আসলে আমি একটি নিষিদ্ধ মাদক সেবনের জন্য ডোপ পরীক্ষায় ব্যর্থ হয়েছি। আমি যেসব মানুষকে হতাশ করেছি, তাদের কাছে আমি আন্তরিকভাবে দুঃখ প্রকাশ করছি।”

তবে এরপরের কথাগুলোতে রাবাদা শুধু একজন ক্রিকেটার হিসেবে নয়, একজন সমাজ সচেতন মানুষ হিসেবেও সামনে আসেন। তিনি বলেন, “অনেকে উপলব্ধিই করতে পারেন না, আমরা কতটা মাদকগ্রস্ত এক সমাজে বাস করছি।”

এই বাক্য শুধু তার আত্মপক্ষ সমর্থনের অংশ নয়, বরং এক গভীর উপলব্ধি—যেখানে তিনি বোঝাতে চেয়েছেন, একজন পেশাদার ক্রীড়াবিদের জীবন কতটা চাপ, চাহিদা আর প্রলোভনের মাঝে ঘেরা।

তবে রাবাদা এখানেই থেমে যাননি। তিনি সাহস করে বলেছেন, “এই একটি ভুল আমাকে সংজ্ঞায়িত করবে না। ক্রিকেট আমার পরিচয়ের একটি বড় অংশ। আমি চাই, মানুষ যেন আমাকে আমার কামব্যাক দিয়েই চিনে রাখে।” তিনি জানিয়েছেন, পরিবার, বন্ধু ও ক্লাবের সমর্থনে তিনি এই কঠিন সময় পার করছেন এবং নিজেকে নতুন করে গড়তে চান।

একজন আন্তর্জাতিক তারকা ক্রিকেটারের কাছ থেকে এমন স্বীকারোক্তি যেমন সাহসের, তেমনি বেদনার। কারণ, রাবাদা শুধু দক্ষিণ আফ্রিকার নন, বিশ্ব ক্রিকেটের এক পরিচিত মুখ। যার হাতে বল থাকলে প্রতিপক্ষ শিবির কেঁপে উঠত, আজ তিনিই নিজের ভুলের কাছে ক্লান্ত, পরিশ্রান্ত।

রাবাদার পাশে এই সময়টায় যারা ছিলেন, তাদের প্রতি কৃতজ্ঞতাও প্রকাশ করেছেন তিনি। “পরিবার, বন্ধু, এজেন্ট, ক্রিকেট দক্ষিণ আফ্রিকা ও গুজরাট টাইটানস—সবাই আমাকে সাহস দিয়েছে। আমি ভেঙে পড়িনি। বরং এই সময়টাই আমাকে শিখিয়েছে, আবার কীভাবে উঠে দাঁড়াতে হয়।”

তবে প্রশ্ন থেকেই যাচ্ছে— এই নিষেধাজ্ঞা তার ক্যারিয়ারে কতটা প্রভাব ফেলবে? এখন পর্যন্ত আন্তর্জাতিক ক্রিকেট কাউন্সিল (আইসিসি) কিংবা ক্রিকেট দক্ষিণ আফ্রিকা আনুষ্ঠানিকভাবে তার বিরুদ্ধে কোনো স্থায়ী শাস্তি ঘোষণা করেনি। আপাতত তিনি “অস্থায়ীভাবে নিষিদ্ধ” আছেন এবং তদন্ত শেষ না হওয়া পর্যন্ত কোনো প্রতিযোগিতায় অংশ নিতে পারবেন না। এমন সময়, যখন সামনে ওয়ার্ল্ড টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপ ফাইনাল— দক্ষিণ আফ্রিকার ইতিহাসে প্রথমবারের মতো সেই ফাইনালের মঞ্চে ওঠার গৌরব অর্জন করেছে তারা। জুনে লর্ডসে অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে সেই ফাইনালে রাবাদার থাকা নিয়ে এখন অনিশ্চয়তা।

অথচ মাঠের পরিসংখ্যানই বলে, তিনি দক্ষিণ আফ্রিকার জন্য কতটা বড় সম্পদ। ৭০টি টেস্টে ৩২৭ উইকেট, ১০৬টি ওয়ানডেতে ১৬৮ উইকেট এবং ৬৫টি টি-টোয়েন্টিতে ৭১ উইকেট— এই পরিসংখ্যান একজন নিখাদ প্রতিভার প্রমাণ। বয়স মাত্র ৩০, সামনে আরও অনেক সময় পড়ে আছে। কিন্তু এমন একটি ঘটনা তার ক্যারিয়ারে কালো দাগ হয়ে রয়ে যাবে কিনা, সেটা নির্ভর করবে তার ভবিষ্যতের ওপর।


আরও পড়ুনঃ
 ড্রাই পিচ কেনো স্পিনারদের স্বর্গ?

তবে প্রশ্ন উঠতেই পারে— রাবাদা কি পারবেন আবার সেই আগের ফর্মে ফিরতে? শরীর তো পারবেন নিয়ন্ত্রণে রাখতে, কিন্তু মানসিকভাবে কি পারবেন সামলে উঠতে?

ইতিহাস বলে, পারবেন। মোহাম্মদ আমির থেকে শুরু করে ওয়ার্ন, ফ্লিনটফ, এমনকি বেন স্টোকস পর্যন্ত— অনেকেই জীবনের কঠিন অধ্যায় পার করে ফিরেছেন। কেউ ফিরেই জিতেছেন বিশ্বকাপ, কেউ আবার ফিরেছেন আরও দায়িত্ববান হয়ে। তাই রাবাদাও পারবেন না, এমনটা ভাবার কোনো কারণ নেই। তার বয়স মাত্র ২৯। পেসারদের জন্য সবচেয়ে কার্যকর সময় এটিই।

রাবাদাও সেই পথেই হাঁটতে চান। ভুল স্বীকার করে ক্ষমা চেয়েছেন, এখন নিজেকে নতুন করে গড়ার পথে এগোচ্ছেন। তার কথায়, “আমি নিজের উপর আস্থা হারাইনি। আমি জানি, কঠোর পরিশ্রম আর আন্তরিকতা দিয়েই আমি আবার মাঠে ফিরব। আমার লক্ষ্য একটাই—আবার দেশের জার্সি গায়ে তুলতে পারা।”

এই ঘটনা শুধুই একটি ডোপ কেলেঙ্কারির নয়, এটি একজন মানুষের নিজের সঙ্গে লড়াইয়ের গল্প। যখন চারপাশ থেকে প্রশ্নবাণ ছুটে আসে, তখন একজন মানুষ নিজের বিশ্বাস নিয়ে দাঁড়াতে পারেন কিনা, সেটাই আসল চ্যালেঞ্জ। কাগিসো রাবাদা সেই চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করেছেন।

এখন শুধু সময়ের অপেক্ষা। তিনি কি পারবেন তার হারানো সম্মান ফিরিয়ে আনতে? পারবেন কি আবার মাঠে দাঁড়িয়ে সেই ভয়ংকর রূপে ফিরতে, যা একসময় ব্যাটারদের ঘুম হারাম করত? হয়তো তা পারা যাবে না একদিনেই, কিন্তু যদি মনের জোর থাকে, তাহলে অসম্ভবও কিন্তু সম্ভব হয়।

আরও খবর

একটি মন্তব্য করুন

দয়া করে আপনার মন্তব্য লিখুন
দয়া করে এখানে আপনার নাম লিখুন

সর্বশেষ খবর

জনপ্রিয় খবর