বিশ্বের সবচেয়ে বড় ফ্র্যাঞ্চাইজি লিগ কি শুধুই ক্রিকেটে সীমাবদ্ধ? আইপিএলের ব্যাট-বলের লড়াইয়েই কি আঁটকে থাকে গোটা বিশ্ব? নাকি এর পেছনেও আছে কোটি টাকার বানিজ্যের গল্প?
যার জন্যই তোড়জোড় করে মাঠে নেমেছে বিসিসিআই, অভ্যন্তরীণ অরাজকতার জন্য স্থগিত হওয়ার পরেও আবারও শুরু করতে চাচ্ছে ইন্ডিয়ান প্রিমিয়ার লিগের এবারের আসর।
কারণ এই টুর্নামেন্ট আর শুধুই ক্রিকেট নয়, এটি এখন এক বিশাল ইন্ডাস্ট্রি। আইপিএলের প্রতি ম্যাচ মানে শুধু ২২ গজে ছক্কা-চারের ঝড় নয়, বরং সেটা মানে হাজারো বিজ্ঞাপন, স্পনসরশিপ চুক্তি, সম্প্রচারস্বত্ব, ফ্র্যাঞ্চাইজিদের বিপুল ব্র্যান্ডমূল্য, কোটি কোটি টাকার টিকিট বিক্রি, কোটি মানুষের বিনোদন এবং এর সঙ্গে জড়িয়ে থাকা হাজার হাজার মানুষের জীবিকা। তাই যখন এমন একটি আয়োজন হঠাৎ থেমে যায়, তখন সেটি শুধু ক্রিকেট নয়, পুরো এক অর্থনৈতিক চক্রকেই স্তব্ধ করে দেয়।

আরও পড়ুন: বাংলাদেশের হয়ে সমিতের খেলা নিয়ে যা বলছে তার ক্লাব কাভালরি
বিসিসিআই সূত্রে জানা গেছে, চলতি আইপিএল যদি এখানেই শেষ হয়ে যায়, তাহলে সরাসরি ক্ষতির অঙ্ক দাঁড়াবে কমপক্ষে ২০০০ কোটি রুপি। আর পরোক্ষভাবে এই ক্ষতির পাল্লা আরও বাড়তে পারে— বিপণন সংস্থা, ট্রাভেল পার্টনার, ইভেন্ট ম্যানেজমেন্ট, হসপিটালিটি, স্থানীয় স্টল মালিক, ক্যাটারিং কিংবা নিরাপত্তা ব্যবস্থা নিয়োজিত বহু মানুষ এই বিশাল চক্রের অংশ।
ভারতীয় মিডিয়া বলছে, প্রতিটি আইপিএল ম্যাচে গড়পড়তায় প্রায় ১০০ থেকে ১২৫ কোটি রুপির লেনদেন হয়। এর মধ্যে ২৫-৩০ কোটি আসে টিকিট বিক্রি ও মাঠসংলগ্ন বিজ্ঞাপন থেকে, ৪০-৫০ কোটি রুপি আসে সম্প্রচারস্বত্ব থেকে এবং বাকি অংশ স্পনসরশিপ ও ফ্র্যাঞ্চাইজিদের বাণিজ্যিক কার্যক্রম থেকে। ম্যাচ বাতিল মানে এই পুরো অর্থনীতিই ক্ষতিগ্রস্ত।
চলতি আসরে এখনো বাকি ১৬টি ম্যাচ। এর মধ্যে রয়েছে চারটি প্লে-অফ, এলিমিনেটর ও ফাইনাল। এই ১৬টি ম্যাচ না হলে ১৬০০ কোটি টাকার সরাসরি লোকসান হবে। সঙ্গে যোগ হবে মাঠ ব্যবস্থাপনা, স্টাফ পেমেন্ট, হসপিটালিটি কস্ট, ভ্রমণ-আবাসন, হোটেল বুকিং, এবং মিডিয়া হাউজগুলোর বিপণনমূল্য হারানোর মতো অতিরিক্ত খরচ— যা নিয়ে গিয়ে দাঁড়াতে পারে ২০০০ কোটি ছাড়িয়ে।

আরও পড়ুন: জুনেই কিউবা মিচেলকে পাওয়ার আশা বাফুফের
নিশ্চিতভাবেই যদি এই পর্যায় থেকে আইপিএল টুর্নামেন্টটি বাতিল করতে হয়, তাহলে আয়োজক সম্প্রচারকারীরা তাদের পূর্ব পরিকল্পিত প্রায় ৫,৫০০ কোটি রুপির বিজ্ঞাপন রাজস্বের এক-তৃতীয়াংশ হারানোর আশঙ্কায় পড়বে। দশটি ফ্র্যাঞ্চাইজিই কোনো না কোনোভাবে এই প্রভাবের শিকার হবে, তবে যারা মূলত আইপিএলের কেন্দ্রীয় রাজস্ব ভাগাভাগি অর্থাৎ সম্প্রচার ও স্পনসরশিপ থেকে বেশি আয় করে, তাদের ওপর এই ধাক্কা আরও প্রবল হবে।
এর বাইরে রয়েছে গেট রেভিনিউ বা টিকিট বিক্রির বিষয়টিও। চারটি প্লে-অফ ম্যাচ আইপিএল/বিসিসিআইয়ের আয়ত্তাধীন হলেও, প্রতিটি দলের নিজ শহরে অনুষ্ঠিত সাতটি ‘হোম’ লিগ ম্যাচ থেকে টিকিট বিক্রির আয় সংশ্লিষ্ট ফ্র্যাঞ্চাইজিরই থাকে। বেঙ্গালুরুর এম চিন্নাস্বামী স্টেডিয়ামে রয়্যাল চ্যালেঞ্জার্স বেঙ্গালুরুর তখনও দুটি হোম ম্যাচ বাকি ছিল, যেখানে টিকিটের দাম প্রায় সব আইপিএল ভেন্যুর চেয়ে বেশি। ফলে ম্যাচ স্থগিত হওয়ায় শুধুই মাঠের খেলায় নয়, বরং আর্থিকভাবেও বড়সড় প্রভাব পড়বে তাদের ওপর। এছাড়া স্পন্সররা প্রত্যেকেই কোটি কোটি রুপি বিনিয়োগ করেছে প্রতিটি ম্যাচে তাদের ব্র্যান্ড এক্সপোজারের জন্য। ম্যাচ বাতিল মানে তাদের সেই ব্র্যান্ডিং আর কাজ করছে না— লোকসানের রোলিং বল ছুটছে আরও দ্রুত।

অর্থাৎ, একটি আইপিএল দল কেবল মাঠে ভালো খেললেই লাভবান হয় না। তাদের রয়েছে ইন-হাউজ স্পনসর, মাল্টি-ব্র্যান্ডিং, সোশ্যাল মিডিয়া কনটেন্ট মার্কেটিং এবং স্টেডিয়ামসংশ্লিষ্ট আয়। ম্যাচ না হওয়া মানে পুরো সাপ্লাই চেইন ভেঙে পড়ে। ফ্যান পার্ক থেকে শুরু করে মিনি কনসার্ট— সব বন্ধ হয়ে যায়। এভাবে প্রত্যেকটি ফ্র্যাঞ্চাইজি গড়ে গড়ে ১০০-১৫০ কোটি রুপির ক্ষতির মুখে পড়তে পারে।
অনেকেই ভাবেন আইপিএল মানে কেবল তারকা খেলোয়াড়, কর্পোরেট বস আর ক্যামেরার ঝলকানি। কিন্তু বাস্তবে আইপিএল মানেই কয়েক হাজার খণ্ডকালীন কর্মসংস্থানের সুযোগ। স্টেডিয়ামে কাজ করেন নিরাপত্তাকর্মী, পরিচ্ছন্নতা কর্মী, টিকিট কালেক্টর, খাবার সরবরাহকারী, গ্রাফিক ডিজাইনার, ভিডিও এডিটর, ইভেন্ট স্টাফ, ট্রান্সপোর্ট ম্যানেজার থেকে শুরু করে ছোটখাটো অগণিত মানুষ।
আরও পড়ুন: অস্ট্রেলিয়ান ক্রিকেটারদের ছাড়াই হতে পারে আইপিএল-পিএসএল
প্রতি ম্যাচে সরাসরি যুক্ত থাকেন গড়ে ২৫০০-৩০০০ কর্মী। চলতি টুর্নামেন্ট বাতিল হলে প্রায় ৫০ হাজারের বেশি শ্রমজীবী মানুষ ক্ষতির শিকার হবেন, যাদের কেউ দিন এনে দিন খায়, কেউ স্টুডেন্ট, কেউ সিজনাল ওয়ার্কার। তাদের জন্য এই টুর্নামেন্ট মানেই ছিল এককালীন উপার্জনের বড় সুযোগ।

অনিশ্চয়তা তৈরি হয়েছে বিদেশি খেলোয়াড়দের ঘিরেও। অনেকে এরই মধ্যে নিজ দেশে ফিরে গেছেন। তবে লক্ষ্ণৌ সুপার জায়ান্টসের মতো কয়েকটি দলের খেলোয়াড় এখনো অপেক্ষায় আছেন, বেশ কিছু বিদেশি ক্রিকেটার এখনো অবস্থান করছে ভারতেই।
বিসিসিআইয়ের সামনে এখন দুটি বড় পথ— হয় দেশেই বাকি ম্যাচ আয়োজন, নয়তো বিদেশে নিয়ে যাওয়া। প্রথমটি করতে চাইলে চেন্নাই, হায়দরাবাদ ও বেঙ্গালুরু— এই তিনটি নিরাপদ শহরে ম্যাচগুলো আয়োজন করা হতে পারে। দ্বিতীয়ত, ইসিবি ইংল্যান্ডে টুর্নামেন্ট শেষ করার প্রস্তাব দিয়েছে, যদি ভারত না পারে।
তবে দেশান্তরে আয়োজন মানেই নতুন বাজেট, নতুন চ্যালেঞ্জ। সেক্ষেত্রে লোকসান কমার পরিবর্তে বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কাই বেশি।
আইপিএল এখন আর শুধুই ক্রিকেট নয়, এটি ভারতের ‘সফট পাওয়ার’, আন্তর্জাতিক অর্থনীতির অংশ, কর্মসংস্থানের মাধ্যম এবং কোটি মানুষের আবেগের নাম। তাই এই টুর্নামেন্ট বন্ধ হয়ে যাওয়া মানে শুধু ২০০০ কোটি রুপি নয়, একটি দেশের ক্রীড়াভিত্তিক অর্থনীতির বুকে গভীর ক্ষতের নাম।

আরও পড়ুন: মে মাসেই আইপিএল শেষ করতে চায় বিসিসিআই
বিসিসিআইয়ের হাতে এখন সময় কম, চ্যালেঞ্জ বড়, কিন্তু সম্ভাবনার দরজা একেবারে বন্ধ হয়ে যায়নি। হয়তো ১৬টি ম্যাচই ঠিক করে দেবে আইপিএলের ভবিষ্যৎ—লোকসানের গল্প, না ফিরে আসার নতুন রূপকথা।