আইপিএলের ইতিহাসে ব্যাটিংয়ের জৌলুস, কৌশলের তীক্ষ্ণতা কিংবা নেতৃত্বের দৃঢ়তায় বহু অধিনায়ক নাম লিখিয়েছেন সোনালি পাতায়। কিন্তু কারও নামের পাশে নেই এমন এক অনন্য কীর্তি, যেটি এখন শোভা পাচ্ছে শ্রেয়াস আইয়ারের মুকুটে। তিন ভিন্ন ফ্র্যাঞ্চাইজিকে ফাইনালে তোলার ইতিহাস গড়েছেন এই ভারতীয় ব্যাটার। তারও চেয়েও অবিশ্বাস্য বিষয় হলো— টানা দুই আসরে দুটি আলাদা দলকে নেতৃত্ব দিয়ে ফাইনালে তোলা কীর্তিও শুধু তারই।
গল্পটা শুরু হয়েছিল ২০১৯ সালে। দিল্লি ক্যাপিটালসের নেতৃত্বে যখন উঠতি বয়সের এক তরুণ হাতে নেন দলের হাল। সাত বছর প্লে-অফের বাইরে থাকা দলটিকে নিয়ে যান সেরা চারে। পরের বছরই, ২০২০ সালে, দিল্লিকে প্রথমবারের মতো পৌঁছে দেন ফাইনালে। যদিও সেই ফাইনালে মুম্বাইয়ের বিপক্ষে শিরোপা অধরাই থেকে যায়। এরপর নেতৃত্ব থেকে কিছুটা ছিটকে গেলেও হাল ছাড়েননি। ২০২৪ সালে যখন কলকাতা নাইট রাইডার্সের নেতৃত্বে ফেরেন, তখন যেন এক নতুন আইয়ারকে দেখা যায়। এক দশকের শিরোপা-খরা ঘুচিয়ে কেকেআরকে এনে দেন তাদের তৃতীয় শিরোপা।

তবে এরপরেও কেকেআর ধরে রাখেনি তাদের অধিনায়ককে। এক বছরের ভেতর দল পাল্টে শ্রেয়াসও এসেছেন নতুন ঠিকানায়। কিন্তু, মাঠে কাজে যেনো সেই পুরো আইয়ারই রয়ে গেছেন। ২০২৫ সালের আইপিএল যেন ছিল তার নেতৃত্বগুণের চূড়ান্ত প্রদর্শনী। এমন এক ফ্র্যাঞ্চাইজিকে ফাইনালে তোলেন, যাদের ইতিহাসটা ছিল ব্যর্থতায় মোড়ানো— প্রীতি জিনতার পাঞ্জাব কিংস।
আরও পড়ুন: হারিসের ঝড়ো সেঞ্চুরিতে পাকিস্তানে হোয়াইটওয়াশ বাংলাদেশ
২০১৪ সালের পর আর কোনোবার ফাইনালে উঠতে পারেনি তারা। টানা ১১ বছর কেবলই হতাশা আর মাঝপথে থেমে যাওয়ার গল্প। সেই গল্পের মোড় ঘুরে যায় শ্রেয়াস আইয়ারের নেতৃত্বে। পাঞ্জাব আবারও জায়গা করে নেয় ফাইনালে, আর ক্রিকেটভক্তরা অবাক বিস্ময়ে দেখেন— কীভাবে একজন মানুষ একের পর এক ভাঙেন সীমা, গড়েন নতুন উচ্চতা।
মুম্বাই ইন্ডিয়ান্সের বিপক্ষে সেমিফাইনালে ম্যাচটি যেন হয়ে ওঠে শ্রেয়াস আইয়ার নামক অধ্যায়ের একটি নিখুঁত সারাংশ। মুম্বাই প্রথম ইনিংসে তোলে ২০৩ রান, এমন একটি স্কোর যেটা পার করে তারা আগে কখনও হারেনি— ১৮ বার দুইশো পেরিয়ে ১৮ বারই জয় পেয়েছে। কিন্তু এবার আইপিএলের ইতিহাস লিখল নতুন করে। আইয়ার একাই উল্টে দিলেন গল্প। ৪১ বলে ৮৭ রানের এক অসাধারণ ইনিংস— যাতে ছিল আটটি ছক্কা, পাঁচটি চার, কিন্তু তার চেয়েও বড় কথা ছিল ঠাণ্ডা মাথা আর অটল আত্মবিশ্বাস।

চাপের মুখে যখন দলের ওপেনাররা ব্যর্থ, তখন তিনে নেমে আইয়ার প্রথমে গড়েন ৯২ রানের এক দৃঢ় জুটি নেহাল ওয়াধেরার সঙ্গে। সেই জুটি গড়ে তোলে জয়ের ভিত্তি। নেহাল আউট হলেও আইয়ার ছিলেন একাই— ম্যাচ শেষ করে আসার সেই অদম্য মনের মানুষ। ম্যাচের পরিণতিও ছিল তাঁর পক্ষে। জয় নিশ্চিত করেন ৬ বল বাকি থাকতেই। আর পাঞ্জাব, এক যুগ পর ফিরে পায় ফাইনালের আলোয়।
আরও পড়ুন: কিউবা জানালেন, “বাংলাদেশের জার্সিতে দেখা হবে মাঠে”
ব্যাট হাতে আইয়ার ছিলেন পুরো আসরেই অনবদ্য। ১৬ ম্যাচে করেছেন ৬০৩ রান, যার মধ্যে রয়েছে ৬টি হাফ সেঞ্চুরি। পাঞ্জাবের হয়ে এক মৌসুমে সবচেয়ে বেশি ছক্কা হাঁকানোর রেকর্ডও এখন তার। ৩৯টি ছক্কার এই কীর্তিতে তিনি ছাপিয়ে গেছেন গেইল ও ম্যাক্সওয়েলের মতো ব্যাটিং দৈত্যদের। আর অধিনায়ক হিসেবে তার জয়ের রেকর্ডও ঈর্ষণীয়— আইপিএলে সর্বমোট ৮৫ ম্যাচে অধিনায়কত্ব করে ৫০টি জয়ে তার জয়ের হার দাঁড়ায় ৫৭.১৪ শতাংশ, যা আইপিএলের ইতিহাসে অনবদ্য এক কীর্তি।
তবে সংখ্যাতত্ত্বের বাইরেও যে বিষয়টা সবচেয়ে বেশি নজর কেড়েছে, তা হলো তার নেতৃত্বের ধরন। ম্যাচের কঠিন মুহূর্তগুলোয় তিনি ছিলেন সামনে। মাঠে দাঁড়িয়ে ছিলেন লড়াইয়ের ফ্রন্টলাইনে। সতীর্থদের উজ্জীবিত করা, পরিকল্পনায় স্থির থাকা এবং নিজের পারফরম্যান্সে উদাহরণ স্থাপন— এগুলোই তাঁকে আলাদা করে তোলে অন্যদের থেকে।

এবছরের আইপিএলে তার পাশে ছিলেন আরও এক কিংবদন্তি— কোচ রিকি পন্টিং। তিনিও গড়েছেন অনন্য কীর্তি। তিনটি ভিন্ন ফ্র্যাঞ্চাইজিকে (মুম্বাই, দিল্লি, পাঞ্জাব) আইপিএলের ফাইনালে তোলার প্রথম কোচ তিনি। পন্টিং-আইয়ার জুটি যেন হয়ে উঠেছে এক প্রেরণার গল্প। কোচের পরিকল্পনা আর অধিনায়কের বাস্তবায়ন— দুয়ে মিলে সৃষ্টি করেছে নতুন ইতিহাস।
আরও পড়ুন: বাংলাদেশে পৌঁছেছেন হামজা চৌধুরী
অন্যদিকে, ইতিহাস ঘেঁটে দেখা যায়— টানা দুই আসরে ভিন্ন দুটি দলকে ফাইনালে তুলেছেন শুধু দুইজন কোচ, স্টিফেন ফ্লেমিং ও ড্যানিয়েল ভেট্টোরি। কিন্তু একজন অধিনায়ক হিসেবে টানা দুই আসরে আলাদা দুটি ফ্র্যাঞ্চাইজিকে ফাইনালে তোলা বা মোট তিনটি দলকে ফাইনালে তোলার নজির একমাত্র শ্রেয়াস আইয়ারেরই।
আগামী মঙ্গলবার ফাইনালে পাঞ্জাবের মুখোমুখি হবে রয়্যাল চ্যালেঞ্জার্স বেঙ্গালুরু। শিরোপা আসবে কি না, তা সময় বলবে। কিন্তু এর আগেই ইতিহাস লিখে ফেলেছেন আইয়ার। তার কীর্তির সামনে জয়-পরাজয়ের হিসাব যেন হয়ে যায় গৌণ। কেননা নেতৃত্ব কেবল মাঠের পরিকল্পনা নয়, নেতৃত্ব মানে প্রেরণা, আত্মবিশ্বাস, আর দলকে অসম্ভবের পথে ঠেলে নেওয়ার সাহস। ঠিক যেমনটা করে দেখিয়েছেন এই “ক্যাপ্টেন ফ্যানটাস্টিক”।

শ্রেয়াস আইয়ার আজ আর শুধু একজন সফল ব্যাটার নন, তিনি হয়ে উঠেছেন নেতৃত্বের প্রতীক— একজন যোদ্ধা, যিনি প্রতিটি জার্সিতে নিজের ছাপ রেখে গেছেন। এবার দেখার পালা ফাইনালে কোহলির বেঙ্গালুরুর বিপক্ষেও এমন অনবদ্য আইয়ারকে দেখা যায় কিনা। যদিও জয়হোক বা না হোক, আইপিএলের ইতিহাসে তার নামটা থাকবে স্বর্ণাক্ষরে লেখা।
আরও পড়ুন: হোয়াইটওয়াশ হওয়ার পরও ওপেনিং জুটি নিয়ে ইতিবাচক সিমন্স