বৃহস্পতিবার, জুন ২৬, ২০২৫
সামি'স কর্নার

১৭ বছরের আক্ষেপ ঘুচিয়ে শিরোপা জিতলো টটেনহ্যাম

‘ফুটবল আপনাকে ছেড়ে যাওয়ার আগে, আপনি ফুটবলকে ছেড়ে যান।’ ইংলিশ ফুটবলে প্রচলিত এই ব্যঙ্গাত্মক উক্তি টটেনহ্যাম হটস্পারকে ঘিরেই বলা হয়েছে। গ্যারেথ বেল থেকে লুকা মদ্রিচ, স্পার্সদের ছাড়ার পরই তাঁরা ছুঁয়েছেন সাফল্যের স্বর্ণচূড়া। হ্যারি কেইনও তেমনই এক দীর্ঘ পথচলার শেষে বিদায় জানিয়ে পেলেন বহু কাঙ্ক্ষিত ট্রফির স্বাদ। টটেনহ্যামের কাছে সাফল্য যেন ছিল কেবল প্রতিশ্রুতির গল্প— যা বাস্তবতায় পরিণত হতো না।

কিন্তু ফুটবল ইতিহাসে কিছু রাত থাকে, যেগুলো একটা ক্লাব, একটা জাতি, এমনকি একজন মানুষকে বদলে দেয়। ২০২৫ সালের মে মাসের এক রাত, ঠিক তেমনই এক অধ্যায় রচনা করল— যেখানে অবশেষে অপেক্ষার অবসান ঘুচলো এক কিংবদন্তির, তিনি দক্ষিণ কোরিয়ার সন হিউং-মিন।

আরও পড়ুন: এলিমিনেটর ম্যাচের আগে আবারও লাহোরে ফিরলেন রিশাদ

বিলবাওয়ের সান মামেস স্টেডিয়ামে ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডকে হারিয়ে ইউরোপা লিগের শিরোপা ছুঁলো টটেনহ্যাম। ৪১ বছরের ইউরোপের খরা কাটল কিংবা ফুরোলো ১৭ বছরের শিরোপার অপেক্ষা। আর এই গল্পের মধ্যমণি সেই মানুষ, যিনি একাই বহন করেছেন ক্লাবের স্বপ্ন, ব্যর্থতা আর প্রত্যাশার বোঝা।

একটা ক্লাব, যে ১৯৮৪ সালের পর ইউরোপে কোনো ট্রফি জিততে পারেনি। যে ক্লাবকে বারবার বলা হয়েছে ‘প্রায় বড়’ হওয়ার অভিশাপে আটকে থাকা নাম। বড় ম্যাচে পিছিয়ে পড়ার অভ্যাস, ঘনঘন কোচ পরিবর্তন, ট্রফিহীন মৌসুমগুলো যেন ক্লাবটির হৃদয়ে গেঁথে দিয়েছিল ব্যর্থতার দাগ।

তবে সবকিছুর মাঝে ছিলেন এক ব্যক্তিত্ব— সন। কোরিয়ার ছোট্ট শহর থেকে উঠে এসে তিনি শুধুই টটেনহ্যামের নয়, পুরো এশিয়ার জন্যই হয়ে উঠেছেন ফুটবলের প্রতিচ্ছবি। ইংলিশ প্রিমিয়ার লিগে টিকে থাকার লড়াই থেকে শুরু করে অধিনায়কত্ব গ্রহণ, সব কিছুর মাঝেই ছিল তাঁর অসীম সংকল্প। ভাষা, সংস্কৃতি, এমনকি বর্ণবৈষম্যের দেওয়ালও তাঁকে থামাতে পারেনি। লড়েছেন ভেঙেছেন, এবং গড়েছেন নতুন ইতিহাস।

আরও পড়ুন: লাহোরে দারুণ সময় কাটাচ্ছেন মিরাজ

২০২৩ সালে যখন হ্যারি কেইন বিদায় নিলেন, তখন প্রশ্ন উঠেছিল, এই ক্লাবের ভবিষ্যৎ কী? কে এখন এগিয়ে নিয়ে যাবে দলকে? সেই সময়টাতেই উঠে আসেন সন। শুধু পারফর্ম করে নয়, নেতৃত্ব দিয়ে, প্রেরণা দিয়ে। যেন বলছিলেন—এই ক্লাব এখন আমার!

এদিকে টটেনহ্যামের বদলে যাওয়ার আরেক গল্পের নাম— অ্যাঞ্জে পোস্টেকোগলু। অস্ট্রেলিয়া-গ্রিস বংশোদ্ভূত এই কোচ ক্লাবে এসে শুধু কৌশলগত পরিবর্তন আনেননি, ভেঙে গড়েছেন একটা সংস্কৃতি। ফুটবলকে তিনি দেখেন সম্মান আর সাহসের চিত্ররূপে। ক্লাবের পুরনো খেলোয়াড়দের আত্মবিশ্বাস ফিরিয়ে দিয়ে তৈরি করেছেন এমন এক পরিবেশ, যেখানে জয়টা আসে বিশ্বাস থেকে, হারতে না শেখার অদম্য মানসিকতা থেকে।

আর তাই হয়তো মঞ্চ প্রস্তুত ছিল এই রাতটির জন্যই। ইউরোপা লিগের ফাইনালে ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডকে ১-০ গোলে হারিয়ে শুধু শিরোপাই জেতেনি স্পার্স, তারা যেন ঘুচিয়ে দিয়েছে নিজেদের দীর্ঘশ্বাস, অসীম গ্লানির অতীত। ব্রেনান জনসনের করা একমাত্র গোলেই লেখা হয় এই ফাইনালের ভাগ্য। তবে সাফল্যের আড়ালে ছিল বহু বছরের জমানো আবেগ।

আরও পড়ুন: চূড়ান্ত হলো আইপিএলের প্লে-অফের লাইনআপ

তবে মাঠের আলো, স্কোরলাইন কিংবা শিরোপার ওজন— সব কিছুকেই ছাপিয়ে গিয়েছিল এক মুহূর্ত। যখন সন ট্রফিটা হাতে তুলে ধরেন, ক্যামেরার লেন্স ধরে রাখে তাঁর চোখের আলো, ঠোঁটে চাপা হাসি, আর হৃদয়ের কান্না। হয়তো তিনি মনে মনে বলছিলেন, “শেষমেশ আমরা পেরেছি!”

এই মুহূর্তটা নিছক ফুটবলীয় অর্জন নয়, বরং একটা আবর্তনের পরিণতি। ২০১৫ সালে অ্যাঞ্জের অস্ট্রেলিয়া জাতীয় দলের কাছে এশিয়ান কাপ হেরে মাঠে কান্নায় ভেঙে পড়েছিলেন সন। সান্ত্বনা দিয়েছিলেন তখনকার কোচ অ্যাঞ্জে পোস্টেকোগলুই। আজ প্রায় এক দশক পর, ঠিক তাঁর অধীনেই জীবনের প্রথম ক্লাব ট্রফির স্বাদ পেলেন সন। যেন নিয়তি নিজেই গল্পটা লিখে রেখেছিল।

২০১৮ সালে জাতীয় দলের হয়ে এশিয়ান গেমসের স্বর্ণপদক ছাড়া, ক্লাব পর্যায়ে সনের নামের পাশে কোনো ট্রফি ছিল না। আজ এই ইউরোপা লিগ ট্রফি শুধু তাঁর ক্যারিয়ারে সংযোজন নয়, এটি তাঁর জীবনের এক অমূল্য মুহূর্ত— যেখানে ফুটবল, আবেগ আর অপেক্ষা একসাথে মিলেমিশে তৈরি করেছে কিংবদন্তির জন্ম।

আরও পড়ুন: ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে ১২৪ রানের রেকর্ড জয় আইরিশদের

ম্যাচ শেষে সন বললেন, ‘ঠিক আছে, আমি কিংবদন্তি। কেন নয়? শুধু আজকের জন্য তো! ১৭ বছর ধরে এটা কেউ পারেনি। অসাধারণ কিছু খেলোয়াড়ের জন্য আজ সেই দিনটা এল। আমি গর্বিত।’

এই ট্রফি শুধু খেলোয়াড় নয়, কোচ পোস্টেকোগলুরও ব্যক্তিগত জয়। কোচিং ক্যারিয়ারের বিভিন্ন ক্লাবেই দ্বিতীয় মৌসুমে শিরোপা জয়ের রীতি এবারও ধরে রাখলেন তিনি। তাঁর মুখেও ছিল আত্মবিশ্বাসের ঝলক, “আমি একজন বিজয়ী। জেতাটাই আমার স্বভাব।”

টটেনহ্যামের এই মৌসুম অবশ্য সহজ ছিল না। ইংলিশ প্রিমিয়ার লিগে তাদের দুঃসময়ই চলছে বটে। ৩৭ ম্যাচেই ২১ হার, পয়েন্ট টেবিলের ১৭তম অবস্থানে দল। পোস্টেকোগলুর চাকরি নিয়েও প্রশ্ন উঠেছিল। কিন্তু ইউরোপা লিগ জয় যেন সব কিছুকে ছাপিয়ে গিয়ে বলল, ‘বিশ্বাস থাকলে সবই সম্ভব।’

অন্যদিকে হতাশার গল্প লিখেছে ফাইনালের অপর দল ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড। মৌসুম শেষে ১৬তম স্থান, ইউরোপীয় প্রতিযোগিতা থেকে ছিটকে যাওয়া নিশ্চিত। কোচ রুবেন আমোরিম সংবাদ সম্মেলনে বললেন, ‘বোর্ড চাইলে আমি নিজেই সরে যাব।’ ইউনাইটেডের জন্য এটি ছিল আরও একটি দীর্ঘ রাত।

কিন্তু এই রাতের গল্প অন্যরকম। রাতটা ছিল সনের। একজন ফুটবলার, যিনি ক্লাব ছাড়েননি, যিনি ক্লাবকে দিয়েছিলেন তাঁর সবটুকুই। অবশেষে ক্লাবের ইতিহাস তাঁর হাতে। আর তাই তিনি বলতেই পারেন— ‘শুধু আজকের জন্য হলেও, আমি কিংবদন্তি।’

আরও পড়ুন: রোনালদোর সঙ্গে দ্বৈরথ ফুটবলের শ্রেষ্ঠ অধ্যায়: মেসি

আরও খবর

একটি মন্তব্য করুন

দয়া করে আপনার মন্তব্য লিখুন
দয়া করে এখানে আপনার নাম লিখুন

সর্বশেষ খবর

জনপ্রিয় খবর