বৃহস্পতিবার, জুন ২৬, ২০২৫
সামি'স কর্নার

তীব্র গরম ও আর্দ্রতায় বল গ্রিপ করতে না পারাটা অদক্ষতা, অযুহাত নয়

সংযুক্ত আরব আমিরাতের বিপক্ষে হার বাংলাদেশের টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটের সামর্থ্যকে আবারও প্রশ্নবিদ্ধ করেছে। কিন্তু এর আগে ব্যাটারদের অদক্ষতার জায়গা সামনে আসলেও এবার সামনে এসেছে বোলিংয়ের অদক্ষতার জায়গা। বাংলাদেশ তাদের টি-টোয়েন্টি ইতিহাসে কখনোজ প্রথম ইনিংসে ২০০ এর বেশি রান করে হারেনি। এবার আমিরাতের বিপক্ষে সেটাই হলো। বোলারদের অদক্ষতায় ২০০ এর বেশি রান করেও হারতে হয়েছে বাংলাদেশকে। বলের উপর নিয়ন্ত্রণ হারানো, একের পর এক ফুলটস, আর ঘেমে ভেজা হাত—সব মিলিয়ে প্রমাণ করছে, আন্তর্জাতিক মানে খেলার মতো প্রস্তুতি এখনও অনেকখানি অপূর্ণ বাংলাদেশের।

অথচ এই দৃশ্যপটের পূর্বাভাস আগেই দিয়েছিলেন বিশ্লেষক ও অন-ফিল্ডের সিইও সৈয়দ সামির। বছর শুরুর দিকে তিনি যে প্রস্তাবনা দিয়েছিলেন বিসিবিকে, সেটিই হতে পারত এই ব্যর্থতার প্রতিষেধক। সৈয়দ সামির বোর্ডকে আহ্বান জানিয়েছিলেন ঢাকা প্রিমিয়ার লিগে ডে-নাইট ম্যাচ অন্তর্ভুক্ত করার পাশাপাশি এনসিএল ও বিসিএলে গোলাপি বলে ডে-নাইট টেস্ট চালুর বিষয়ে। প্রস্তাবটি প্রশংসিত হলেও, তা ব্যক্তিগত ইগোর জালে আটকে বাস্তবায়ন হয়নি। অথচ সেই প্রস্তুতি থাকলে আজকের বাস্তবতায় দাঁড়িয়ে আমরা বলতেই পারতাম—আমরা প্রস্তুত।

বর্তমানে শারজাহর তাপমাত্রা রাতেও ৩৪-৩৬ ডিগ্রি সেলসিয়াস, বাতাসে আপেক্ষিক আর্দ্রতা ৬৪ শতাংশ। এই গরমে ঘেমে হাত ফসকে বল বেরিয়ে যাচ্ছে বারবার। দেখা গেল, নাহিদ রানা তার প্রথম ওভারেই বল ঠিকভাবে ছাড়তে পারলেন না; একটি বল দুইবার পড়ল, আরেকটি ফুলটাস হয়ে মাথার ওপর দিয়ে বেরিয়ে গেল। তানজিম সাকিব ইয়র্কার দেওয়ার চেষ্টা করতে গিয়ে ফুলটাসে নো বল করে বসলেন।

আরও পড়ুন: শিবলির সেঞ্চুরিতে প্রথম দিন বাংলাদেশ ইমার্জিংয়ের

শেখ মেহেদী আগের দিন, প্রথম ম্যাচে ফুলটস দিচ্ছিলেন ধারাবাহিকভাবে। কারণ একটাই—গ্রিপের ঘাটতি। শুধু ঘাম নয়, ডিউ বা শিশির-ও ছিল বড় বাধা। বারবার লিটন দাস, শান্ত কিংবা রিশাদ বল মোছেন টাওয়েল দিয়ে। ডিউয়ের কারণে বল স্যাঁতসেঁতে, আর ঘামের কারণে হাত পিছল—দুটি কারণেই বোলাররা নিয়ন্ত্রণ হারাচ্ছিলেন। বিশেষ করে যেসব বোলার একটু গতি নির্ভর, যেমন তানভীর, তারা এই পরিস্থিতিতে আরও বেশি ভুগেছেন।

আরও পড়ুন: সাকিবের উপস্থিতিতে বেড়েছে দলের আত্মবিশ্বাস, দাবী লাহোর মালিকের

বোলারদের মাঝে তুলনামূলকভাবে রিশাদ হোসেন ভালো বল করেছেন। কারণ তাঁর স্টক ডেলিভারিই তুলনামূলক ধীরগতির, যা এই কন্ডিশনে খাপ খাইয়ে নিতে সাহায্য করেছে। অন্যরা যখন বারবার শর্ট পিচ কিংবা ফুলটাসে ভুগছেন, রিশাদ তার বোলিংয়ের গতি ও লাইন সমন্বয় করে ফেলেছেন দ্রুতই। এই নমনীয়তা আসলে আসে অভ্যাস থেকে—যা বাকিদের মধ্যে অনুপস্থিত।

যদি ডোমেস্টিক ক্রিকেটে ডে-নাইট সংস্করণ থাকত, যদি ডিউয়ের ভেতরে খেলার অভ্যাস তৈরি হতো, তাহলে হয়তো এমন দিনে বাংলাদেশ বোলারদের এতটা অসহায় লাগত না। সৈয়দ সামিরের মতে, পিংক বল টেস্টের প্রস্তাব যদি এনসিএলে অন্তর্ভুক্ত হতো, প্রত্যেক দল অন্তত একটি করে গোলাপি বলে খেলত, তাহলে আন্তর্জাতিক ম্যাচে বোলারদের হাতে বল ফসকে যেত না। অথচ দেশের প্রথম শ্রেণির ক্রিকেট এখনো দিনের আলোতেই সীমাবদ্ধ। শুধুমাত্র বিপিএলে রাতের খেলা হয়, যা স্বল্প পরিসরে। গত বছরও শারজাহতে একই দৃশ্য দেখেছিলাম। রহমানুল্লাহ গুরবাজের সেঞ্চুরিতে হেরে গিয়েছিল বাংলাদেশ, কারণ ডিউয়ের ভেতরে বোলিং করতে পারেনি। এবারও ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি ঘটল। কিন্তু প্রশ্ন থেকেই যায়—এই শিক্ষা কবে গ্রহণ করবে কর্তৃপক্ষ? এটি কিন্তু শুধুমাত্র ক্রিকেটারদের দায়িত্ব নয়। প্লেয়ারদের স্কিল উন্নয়নের জন্য কাঠামোগত প্রস্তুতি তৈরি করে দেওয়া কর্তৃপক্ষেরও দায়িত্ব। খেলোয়াড়রা আন্তর্জাতিক পর্যায়ে কীভাবে ডিউ কন্ডিশনে বল গ্রিপ করবে, সেটা শিখিয়ে দেওয়া উচিত ছিল ডোমেস্টিক পর্বেই। অথচ আমাদের ঘরোয়া লিগে সেই পরিস্থিতির অনুশীলনের সুযোগই নেই। একে তো অতিরিক্ত গরম, তার উপর স্যাঁতসেঁতে বল—সব মিলিয়ে পরিস্থিতি থার্ড ডিভিশন ক্রিকেটের মতো দেখিয়েছে।

শারজাহতে গেলো আট ম্যাচের আটটিতেই আগে ব্যাট করা দল হেরেছে, এখানে ডিউ ফ্যাক্টর এতটাই গুরত্বপূর্ণ। টসে জিতে এখানে তাই আগে বল করতে চায় সবাই। শুধু শারজাহ নয়, এশিয়ার অনেক মাঠেই ডিউ ফ্যাক্টর থাকে। এমনকি ভারতের মোহাম্মদ শামি এই ডিউ ফ্যাক্টরকে ওভারকাম করবেন বলে নিজের গ্রামের বাড়িতে বল ভিজিয়ে ভেজা বলে প্রাক্টিস করেছেন যেন শিশিরে ভেজা বলে অ্যাডজাস্ট করতে পারেন। শিশির তো থাকবেই, সবসময় তো টসও জিতবে না এক দল যে টসে জিতে বোলিং আগে করে জিতে যাবো। টস হেরে যদি আগে ব্যাট করতে হয়, সেক্ষেত্রে কি করা যেতে পারে, কিভাবে ওভারকাম করতে হবে, এটিও তো এক্টা দলের পরিকল্পনায় থাকা উচিৎ।

আরও পড়ুন: সেঞ্চুরির পরও কেন একাদশে নেই ইমন- জানালো বিসিবি

আন্তর্জাতিক ক্রিকেটার হতে হলে সব কন্ডিশনেই খেলোয়াড়দের মানাতে হবে। শিশিরের মাঝে বল করাতে বাংলাদেশের সবচেয়ে বেশি দক্ষ মুস্তাফিজুর, যেই দক্ষতাও তিনি আয়ত্ত্ব করেছেন মূকত আইপিএল খেলে। কারণ সেখানে রাতেও প্রাক্টিস হয়। কিন্তু আমাদের দেশের দিকে তাকালে দেখা যায় অধিকাংশ প্রাক্টিস সেশন হয় দিনের বেলা, অর্থাৎ সূর্যালোকের নিচে। ফ্লাডলাইট কিংবা রাতের বেলা অনুশীলন হয় না। যে কারণে ফিল্ডারদেরও ব্যর্থতার জায়গা স্পষ্ট হয়ে উঠে। এদিকে বোলারদের গ্রিপ করার অদক্ষতা তো রয়েছেই। তাই ডিউ ফ্যাক্টরের জন্য বল গ্রিপ করতে না পারা, আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে এটা কোনো অজুহাত হতে পারে না। খেলোয়াড়দের এই চ্যালেঞ্জ সামলানোর সক্ষমতা থাকা দরকার, আর সেটা গড়ে তুলতে হয় নিয়মিত অনুশীলন আর অভিজ্ঞতার মাধ্যমে। এই অভিজ্ঞতা গড়ে দেয় ঘরোয়া ক্রিকেট। তাই ডে-নাইট ম্যাচ, পিংক বল—সবই জরুরি ভবিষ্যতের জন্য। বাংলাদেশ ক্রিকেটের উন্নয়ন কাঠামোয় এই বাস্তবতাগুলো যুক্ত না করলে ‘ডিউ ফ্যাক্টর’ আর ‘ঘামা হাত’ শুধু অজুহাতই থেকে যাবে।

আরও খবর

একটি মন্তব্য করুন

দয়া করে আপনার মন্তব্য লিখুন
দয়া করে এখানে আপনার নাম লিখুন

সর্বশেষ খবর

জনপ্রিয় খবর