ইনজুরির ব্যাপারে বিত্তবানদের কাছে সাহায্য চেয়ে ফেসবুকে নিজের প্রোফাইল থেকে একটি পোস্ট করেছিলেন সালমান হোসেন। জানিয়েছিলেন পায়ের ইনজুরির জন্য যেই অর্থের প্রয়োজন সেটি তার পক্ষে বহন করা সম্ভব নয়। সালমানের সেই পোস্ট দেখে ব্যক্তিগত উদ্যোগে বিসিবি সভাপতি ফারুক আহমেদের কাছে সাহায্যের আবদার করেছিলেন দেশের জনপ্রিয় ক্রিকেট বিশ্লেষক ও আন্তর্জাতিক ধারাভাষ্যকার সৈয়দ আবিদ হুসাইন সামি।
সামির সেই আবদারে তাৎক্ষণিকভাবে সাড়া দিয়েছেন বিসিবি প্রেসিডেন্ট এবং তিনি সালমানকে সাতক্ষীরা থেকে ঢাকায় নিয়ে আসার জন্য বলেছেন। বিসিবি সভাপতি আশ্বাস দিয়েছিলেন সালমান ঢাকায় আসার পর বিসিবির মেডিকেল ইউনিট তাকে দেখবে এবং এরপর যে প্রসিডিউরটা মেইনটেইন করা দরকার বোর্ড সম্পূর্ণ দায়িত্ব নিয়ে সেই কাজটা করে দিবে। অবশেষে বৃহস্পতিবার (১৫ মে) বিসিবি প্রেসিডেন্ট সালমানের সাথে দেখা করেছে এবং সালমানের সুস্থ হবার পুরো প্রক্রিয়া শুরু হয়ে গেছে।
আরও পড়ুন: কাকা-ইতোদের সাথে প্রীতি ম্যাচ খেললেন তাবিথ আউয়াল
বিসিবি সভাপতির সাথে কি আলাপ হয়েছে কিংবা দেশের ক্রিকেটীয় কালচারে একজন ফার্স্ট ক্লাস ক্রিকেটার ইনজুরির সাথে কিভাবে লড়াই করে বা এই পুরো প্রক্রিয়া নিয়ে ‘অন ফিল্ড’-এর পর্দায় সৈয়দ আবিদ হুসাইন সামির সাথে খোলামেলা আলাপ করেছেন সালমান, জানিয়েছেন নিজের অভিজ্ঞতার কথা। সৈয়দ সামির সাথে একান্ত সাক্ষাৎকারে কি আলাপ করলেন সালমান সেটাই চলুন জেনে নেওয়া যাক-

সৈয়দ সামি: আজকে যখন গেলেন বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডে। বিসিবির প্রেসিডেন্ট ডিরেক্ট আপনার সাথে দেখা করেছেন, কি বলেছেন?
সালমান: “আমি যখন নিচে ছিলাম তখন উনি আমাকে দেখে চিনতে পারছে। উনি বলেছেন ‘তুমি সেই সালমান?’ আমি বললাম, ‘জি স্যার’। তারপরে তিনি আমাকে উপরে যেতে বলতেছেন। তো উপরে যাওয়ার পর ইতস্ততা করতেছিলাম যে আসলে আমি কি বলব। তিনি নিজে থেকেই বলতেছে কোন ভয় নাই তুমি বলো তোমার কি সমস্যা, খুলে বলো। স্যার শুনলো আমার কিভাবে ইনজুরি হলো, কই খেলতেছি বা কি বৃত্তান্ত। সবকিছু বললাম, বলার পরে তিনি বলছেন, ‘দেখো আমাদের বিসিবির তো একটা বেসিক নিয়ম আছে নিয়মের ভিতর দিয়ে আমাদের যেতে হবে। তো সেইভাবে আমি তোমার জন্য যতটুকু করার বিসিবি থেকে সর্বোচ্চ সহযোগিতা করা সম্ভব সেই ব্যবস্থা করে দিব এবং দেবাশিষের (বিসিবির ডাক্তার) সাথে কথা বলে তোমার কোথায় কি অপারেশন করলে ভালো হবে সেটার ব্যবস্থা আমি করে দেব।’ ”
আরও পড়ুন: ২৮ সদস্যের দল ঘোষণা আর্জেন্টিনার, ফিরছেন মেসি
সৈয়দ সামি: “আমাদের দেশে একটা ন্যাশনাল ক্রিকেটারের এমন ইনজুরি হলে সেই ইনজুরির ব্যাপারটা কেউ জানে না। মানে আপনি এনসিএল খেলেছেন, আপনি ফার্স্ট ক্লাস ক্রিকেটার। তার মানে আপনি সিস্টেমের ক্রিকেটার। তারপরও সেটা কেউ জানে না। আমাদের দেশে এই সুযোগটা নাই। ধরুন আমি যদি বাইরের দেশে চিন্তা করি যে স্পোর্টস মেডিসিন সেন্টার থাকে। প্রত্যেকটা দেশে স্পোর্টস মেডিসিন সেন্টার থাকে। সেখানে ন্যাশনাল পুলভুক্ত যে সমস্ত অ্যাথলেটরা আছেন তারা তাদের ইনজুরি চেকআপ থেকে শুরু করে সবকিছু জানতে পারেন। আমাদের বাংলাদেশে এই ব্যাপারটার আসলে অভাব কেমন অনুভব করেন আপনারা?”
সালমান: “আসলে আমরা তো অনুভব করি। যারা নতুন ক্রিকেটার, যারা এজ লেভেল খেলে তাদেরও কিন্তু ইনজুরি হয়। মোটামুটি সবারই ক্রিকেট খেলতে বা ফুটবল খেলা যে খেলাই বলেন ইনজুরি অবশ্যই হবে। কিন্তু আমাদের দেশে ওরকম কোন প্রসিডিউর আমি দেখি না। কারণ আমরা ফার্স্ট ক্লাস খেলি, ফার্স্ট ক্লাস খেলার পরে একটা বছর গ্যাপ। এর ভিতরে কোনো ফিজিও, কোন ট্রেইনার বা কেউ আমাদের সাথে যোগাযোগ করে না। মানে আমরা কি অবস্থায় আছি, আমাদের স্বাস্থ্যের কি অবস্থা, কিভাবে আমাদের মেইনটেইন করে চলতে হবে এগুলোর খোজ কেউ নেয় না।”

“আমি জানিনা আসলে বোর্ডের ব্যাপারটা, ওটা তো আমার জানার কথাও না। আমাদের এরকম কেউ কখনো ফোন দেয়া হয় না। ঠিক খেলা শুরু হওয়ার এক মাস আগে একটা ফিটনেস ক্যাম্প হবে, ওই সময় ডাকবে। ওই এক মাসে আপনি কি ইমপ্রুভ করবেন। জিম করা বা এগুলা এগুলা ছাড়া আর কি করার আছে। কতটুকু লোড নিলে আমি ভালো থাকবো বা এর থেকে বেশি লোড নিলে যে ইনজুরি হবে এইগুলো আমাদের কখনো গাইড করা হয় না।”
আরও পড়ুন: সাবিনা-মনিকাদের গোলবন্যায় ২৮ গোলের জয় পারো এফসির
সৈয়দ সামি: “পৃথিবীর প্রত্যেকটা দেশেই প্রত্যেকটা অ্যাথলেটদের জন্য স্পোর্টস মেডিসিন সেন্টার থাকে। ইন্ডিয়ার একটা উদাহরণ যদি দেই, সেখানে ফার্স্ট ক্লাস লেভেলের ক্রিকেটার যারা আছেন তাদের জন্য একটা অ্যাপ ডিজাইন করা আছে। সেই অ্যাপে সকালবেলা ঘুম থেকে ওঠার পর বেশ কয়েকটা প্রশ্নের উত্তর দিতে হয়। সে প্রশ্নের উত্তর যখন অটোমেটিক সিস্টেমে দেয়া হয়, তারপর সেটার একটা ফলোআপ করা হয় যে ওই ক্রিকেটারের আসলে সমস্যা কি, সে কোনো প্রবলেমে আছে কিনা কিংবা যদি কোনো ইনজুরি হয় তাৎক্ষণিকভাবে বিসিসিআইয়ের যে স্পোর্টস মেডিসিন সেন্টার আছে সেখানে তাদেরকে নিয়ে যাওয়া হয়।”

“আমাদের দেশের ক্রিকেটে আমরা আসলে কতখানি পিছিয়ে আছি। আমরা যে বারবার সিস্টেম ডেভেলপমেন্টের কথা বলি, সেই জায়গায় সালমানের কিন্তু ফেসবুকে স্ট্যাটাস দিয়ে জানানোর কথা না যে ভাই আমি ইনজুরড। আমাদের দেশে স্পোর্টস মেডিসিন সেন্টার না থাকার কারণে অনেক ক্রিকেটারের ক্যারিয়ার সত্যিকার অর্থে অনেক লম্বা হয় না। আমাদের এই সার্কিটটা কি এত প্রফেশনাল হতে পেরেছে যে, কেউ প্রথম পেশা হিসেবে ক্রিকেটটাকে বাছাই করতে পারবে?”
সালমান: “আসলে সত্যি কথা বলতে, ন্যাশনাল টিমের প্লেয়ার বাদে আমাদের দেশে কেউ ওইভাবে স্বাবলম্বী না। যারা ন্যাশনাল টিমে কিছুদিন খেলছে বা ন্যাশনাল টিমের আশেপাশে আছে, এরা ছাড়া যারা ফার্স্ট ক্লাস খেলে বা প্রিমিয়ার ডিভিশন খেলে এরা ওই রকমভাবে স্বাবলম্বী না। তাদের একটা মেজর ইনজুরি হলে অপারেশন করতে গেলে অবশ্যই বিসিবির বা কোন একটা জায়গা থেকে হেল্প নিয়ে অপারেশন করানো লাগবে। সবাই মনে করে যে হচ্ছে আমি ফার্স্ট ক্লাস খেলে ফেলছি বা লিস্ট ও খেলে ফেলছি আমি মনেহয় অনেক টাকা আয় করে ফেলছি। আসলে এটা হচ্ছে ভুল ধারণা।”
“আমি বিগত প্রিমিয়ার লীগে তিনটা ম্যাচ খেলছি। আমি একটা টাকাও পাইনি। আমি এখনো মনে হয় গাড়ি ভাড়ার টাকা পাব। একটা টাকাও পাইনি। মানে এটা আমি অন ক্যামেরার সামনে বলতেছি যে সেই টিমের সাথে আমি টাকার বিষয়ে ঝগড়াও করেছি। আমি বলেছি যে আমি তিনটা ম্যাচ খেলছি, অন্তত আপনারা আমার ৫০ হাজার টাকা দিতে পারতেন। আমার একজোড়া জুতো হইতো বা আমি আমার শরীরের পিছনে কিছু খরচ করতে পারতাম। অন ক্যামেরায় আমি বলতেছি তারা একটা টাকা আমালে দেয়নি। আমার হয়তো তাদের সাথে চুক্তি নাই। তারপরও তাদের দায়বদ্ধতার দিক থেকে তারা আমাকে কিছু টাকা দিতে পারতো।”
আরও পড়ুন: পিএসএলের দল ছাড়াই মাঠে গড়াবে গ্লোবাল সুপার লিগ
“আমাদের দেশে ন্যাশনাল টিমের বাদে যারা খেলে তাদেরকে বেশিরভাগ মানুষই মনে করে কি এরা হচ্ছে কামলা দিচ্ছে। এখানে সেই সম্মানটা আমাদের দেওয়া হয় না। যারা ন্যাশনাল টিমে গেছে তাদের আলাদা কদর হচ্ছে, ফার্স্ট ক্লাস বা এরকম লিস্ট এ যারা খেলে তাদের আলাদা কদর দেখানো হয়, সেটা কোচ থেকে হোক বা অফিশিয়াল থেকে হোক বা নিচের সাধারণ মানুষ হোক সবাই এমনটাই ভাবে যে যারা ন্যাশনাল টিমে গেছে তারা বাদে মনে হয় কেউ প্লেয়ার না।”
“আপনি যদি একটা জিনিসের কদর না করেন সে কিন্তু একটা সময় বড় জায়গায় যেতে পারবে না বা ন্যাশনাল টিমে খেলতে পারবে না। এখন আপনি তাকে এক চোখে দেখতেছেন আর ন্যাশনাল টিমের প্লেয়ারদের এক চোখে দেখতেছেন, এটা কিন্তু ঠিক না। এটাই হচ্ছে আমাদের ক্রিকেটে। আমরা এটাই দেখতেছি যে তেলা মাথায় সবাই তেল দিতেছে আর আতেল মাথায় কেউ আর তেল দিচ্ছে না। যেরকম আমি নিজেই তার প্রমাণ। আমি ইনজুরিতে পড়ছি এখন আমি যেহেতু ফার্স্ট ক্লাস প্লেয়ার আমাদের ফিজিও যারা আছে তাদের নিয়মিত আমাদের খোঁজ রাখা উচিত।”

“যারা আমাদের দায়িত্বে তারা কিন্তু আমাদের সারা বছর একবারও ফোন দিয়ে শোনে না, ভাই আপনার পায়ের অবস্থা কি বা আপনার বডির অবস্থা কি আছে, নিয়মিত জিম করতেছেন কিনা বা নিয়মিত নিউট্রিশন খাদ্য এগুলো নিতেছেন কিনা বা আপনার একটা প্রোগ্রাম দিচ্ছি আপনি এইভাবে কাজগুলো করবেন। এভাবে আমাদের খোঁজ নেওয়া হয় না। এজন্য আমাদের আমাদের প্লেয়াররা বেশিরভাগই ইনজুরি প্রবণ। আমরা কিছুদিন খেলতে না খেলতে ইনজুরিতে পড়ে যাই। বড় ধরনের অনেক প্রতিভা থাকা সত্ত্বেও একটা সময় ইনজুরির কারণে হয়তো খেলাটাও ছেড়ে দিতে হয়।”
“আমি যদি এখন অপারেশনটা না করাইতে পারি তাহলে তো আমার কোনো না কোনভাবে খাইতে হবে। আমার বাঁচতে তো হবে। আমার এখন বোর্ড যেহেতু দায়িত্ব নিয়েছে। আমি ফারুক স্যারের কাছে অনেক কৃতজ্ঞ যে তিনি দেরি করেননি। আমার খোঁজ নিয়েছেন এবং সঙ্গে সঙ্গে তিনি ব্যবস্থা নেওয়ার কথা বলছেন। আমি নিজে থেকেই শঙ্কিত ছিলাম যে আমার ক্যারিয়ারটা আসলে আর আসবে কিনা। আপনাকেও ধন্যবাদ, আপনার মাধ্যমে জিনিসটা হইছে। আপনার সাথে আমার এর আগে পরিচয় ছিল না। আপনি আমার স্ট্যাটাস দেখে নিউজ করছেন, আমি পরে ফেসবুকে ঢুকে দেখে অবাক হয়ে গেছি।”
আরও পড়ুন: ড্যারেল মিচেলের বদলে লাহোরে সাকিব
সৈয়দ সামি: “আমাদের দেশের ক্রিকেটটা আসলে আল্লাহ চালায়, মানে আল্লাহ নিজের হাতে চালায়। কারণটা হচ্ছে যে একটা দেশের ক্রিকেটিং স্ট্রাকচারটা যেরকম থাকা উচিত সেরকম না থাকার পরেও যেভাবে আমাদের দেশে ক্রিকেটাররা উঠে আসে এটা আল্লাহর রহমত ছাড়া আসলেই সম্ভব না। কারণ এত কম ফ্যাসিলিটির মধ্যে সত্যিকারের অর্থে একটা ক্রিকেটিং স্ট্রাকচার দাঁড়াতে পারেননা।”