বৃহস্পতিবার, জুন ২৬, ২০২৫
সামি'স কর্নার

ফিরে এসেই রাজত্ব: বাসেলে ইতিহাস গড়লেন ‘সুইস মেসি’ শাকিরি

যে ক্লাবের জার্সিতে একদিন পা রেখেছিলেন পেশাদার ফুটবলের প্রথম ধাপে, যে মাঠে বল পায়ে হাতেখড়ি হয়েছিল, সেই বাসেলেই এক যুগ পরে ফিরে এসে গড়লেন ইতিহাস। একসময় যেখান থেকে ইউরোপ জয় করতে পাড়ি জমিয়েছিলেন বায়ার্ন, ইন্টার, লিভারপুল হয়ে বিশ্বকাপের মঞ্চে— সেই মানুষটাই ফিরে এলেন বাসেলে, যেখানে একদিন তাঁকে “সুইস মেসি” বলা হতো।

কখনো কখনো ফুটবল শুধু গোল, জয় কিংবা পরিসংখ্যানের গল্প হয় না—তা হয়ে ওঠে একটি অঞ্চলের, একটি ক্লাবের, এমনকি একটি জাতির আবেগ ছুঁয়ে যাওয়া উপাখ্যান। সুইজারল্যান্ডের সেই উপাখ্যানের নাম এখন একটাই— জেরদান শাকিরি।

আরও পড়ুন: বাংলাদেশে আসতে চান কুইন সুলিভান

এক দশক আগে যে কিশোর ক্লাব থেকে রঙিন স্বপ্ন দেখতে ইউরোপ যাত্রা করেছিলেন, সেই শাকিরি আজ কিংবদন্তিরূপে ফিরে এসে বদলে দিয়েছেন ক্লাবটির ভাগ্যরেখা। আট বছর পর বাসেলের লিগ শিরোপা জয়ের পেছনে সবচেয়ে বড় অবদান যাঁর, তিনি এখন সেই শহরের হৃদয়ে চিরস্থায়ী আসন গেড়ে নিয়েছেন।

সময়টা খুব বেশি দূরের নয়, যখন শাকিরিকে নিয়ে আমেরিকান ফুটবল মিডিয়ায় ভরছিল হতাশা আর বিরক্তির ছায়া। ‘এক্সট্রা টাইম টক’-এর ভাষ্যে— “শাকিরি যেন মাঠে শুধু শরীরটাকে টেনে নিয়ে বেড়ান, যেন আগ্রহই নেই খেলার প্রতি।”

শিকাগো ফায়ারের হয়ে খেলার সময় সংবাদ সম্মেলনে তার অনাগ্রহ, মাঠে ধীর গতি ও মনোযোগহীনতা চোখে পড়েছিল সবার। এমনকি ইউরোপে তার ফিরে আসার সম্ভাবনাও তখন অনেকের কাছে হাস্যকর ঠেকেছিল। বয়স, পারফরম্যান্স, বেতন—সবকিছুই ছিল তার বিপক্ষে। তবুও, সেই অসম্ভবকে সম্ভব করেই যেন এক স্বপ্নপূরণের গল্প লিখে ফেললেন শাকিরি।

আবারও পড়ুন: শমিতের দুর্দান্ত এসিস্টে বড় জয় ক্যাভালরির

আগস্টে হঠাৎই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বাসেল একটা বাক্যে বিস্ময়ের বিস্ফোরণ ঘটায়— “ওয়েলকাম হোম।” তার আগ পর্যন্ত বিষয়টিকে গুজব, মিথ্যা, বিভ্রান্তিকর বলে উড়িয়ে দিয়েছিলেন সবাই। কারণ? শাকিরির বার্ষিক বেতন ছিল ৮ মিলিয়ন ডলারের বেশি। অথচ সেই ‘অসম্ভব’ স্বপ্নটিই বাস্তব হলো।

ইউরোপিয়ান মিডিয়া তখন দাবী করেছিল— “জুরিখ বিমানবন্দরে নেমেই শাকিরি বাসেলের সঙ্গে ২০২৭ পর্যন্ত চুক্তি করেন। এমনকি তার বন্ধুরাও জানতেন না ফিরছেন তিনি। পুরো বিষয়টি ছিল পরিকল্পিত এক চমক।” শাকিরি নিজেই বলেন, “আমাদের লক্ষ্যই ছিল সবাইকে চমকে দেওয়া।” সেই চমকই পরে পরিণত হয় ঐতিহাসিক এক মৌসুমে।

শাকিরির ফেরা যেন সুইস ফুটবলে ফিরিয়ে আনে স্ট্যানলি ম্যাথিউসের মতো কিংবদন্তিদের গল্প। সেন্ট জ্যাকব পার্কের বারান্দা থেকে হাজারো সমর্থকের উদ্দেশে দেওয়া তার বক্তব্যে বাজে আবেগের ঝড়। শার্ট বিক্রি বেড়ে যায় হু হু করে। যারা একসময় তাকে ডাকত ‘সুইস মেসি’, তারা আবারও বিশ্বাস করতে শুরু করে ম্যাজিকের।

তবে মাঠে ফেরার শুরুটা মোটেও রূপকথার মতো ছিল না। কাপ ম্যাচে লোয়ার লিগের স্তাদ নিয়নাইসের বিপক্ষে একমাত্র গোলটি আসে তার অতিরিক্ত সময়ের পেনাল্টিতে, যা দলের হার এড়ায়।

আরও পড়ুন: স্কাই স্পোর্টসের মৌসুম সেরা একাদশে জায়গা পেলেন হামজা

এরপর লিগে ছিল তা টানা গোলহীনতা। এফসি জুরিখের কাছে ২-০ ব্যবধানে হারার ম্যাচে প্রথমবার পুরো ৯০ মিনিট খেললেও আলো ছড়াননি। বরং সতীর্থদের ওপেনলি সমালোচনা করে সমালোচনার মুখে পড়েন। পরের ম্যাচে লুসার্নের বিপক্ষে একটি ফ্রি-কিক মিসের পর তো শুরু হয়ে যায় প্রশ্ন— “শাকিরি কি ফ্লপ হয়ে যাচ্ছেন?”

সেই চাপ থেকেই হয়তো নিজেকে খুঁজে নেন শাকিরি। এরপর থেকে দেখা যায় এক অন্য শাকিরিকে— যিনি গোল বানান, নিজেই করেন গোল, আবার মাঝমাঠ থেকে খেলাটাও গড়েন। উইন্টারথারের বিপক্ষে ৬-১ গোলের জয়ে দুই গোল ও তিন অ্যাসিস্ট দেন, যার একটি আসে সরাসরি কর্নার থেকে। সেভেটের বিপক্ষে করেন দুর্দান্ত হ্যাটট্রিক। তাকে নিয়ে ফেরা লেখা হয়— “এখন বাসেলের আক্রমণভাগের সবাই যেন অভ্যস্ত সেই জাদুকরের সঙ্গে। মোটো একটাই— তুমি দৌড়াও, বল ঠিকই আসবে তার পা থেকে।”

শীতকালীন বিরতির পর তার ফর্ম যেন ছুঁয়ে ফেলে নতুন উচ্চতা। বাসেলের অধিনায়কত্ব পেয়ে যেন হয়ে ওঠেন নতুন প্রেরণার কেন্দ্রবিন্দু। মৌসুমে ৩১ ম্যাচে করেন ১৮ গোল ও ২০ অ্যাসিস্ট— যা ইউরোপজুড়ে অসাধারণ এক অর্জন। শুধু সালাহ ও তরুণ ভিক্টরের তার চেয়ে সরাসরি গোলে অবদান বেশি রেখেছেন। তবে সব মিলিয়ে এটি ছিল শাকিরির অষ্টম লিগ শিরোপা ও ১৮তম ট্রফি— কিন্তু সবচেয়ে আবেগঘন, তা কিন্তু বলাই যায়!

আরও পড়ুন: ভূটানকে হারিয়ে সাফের সেমিফাইনালে বাংলাদেশ

সর্বশেষ ম্যাচে লুগানোর বিপক্ষে ৫-২ ব্যবধানে জয়ের ম্যাচে করেন দুর্দান্ত হ্যাটট্রিক— তাও মাত্র ৯ মিনিটে! ম্যাচ শেষে তাকে ঘোষণা করা হয় সুইস সুপার লিগের ৩৫তম রাউন্ডের সেরা খেলোয়াড়। এবং সেই জয়েই নিশ্চিত হয়ে যায় বাসেলের ২১তম লিগ শিরোপা, কারণ প্রতিদ্বন্দ্বী সার্ভেট ও ইয়াং বয়েজ ড্র করেছিল।

সাংবাদিক ফ্লোরিয়ান রাজ লিখেছেন— “জেরদান শাকিরি বৃদ্ধ ভক্তদের কাছে সেই পুরনো দিনের এফসিবি জুনিয়র, যিনি ফিরে এসেছেন শিকড়ে। তরুণ ভক্তদের কাছে তিনি সুইজারল্যান্ডের তারকা, যাকে তারা এখন নিয়মিত দেখতে পাচ্ছেন মাঠে। এবং যিনি সত্যিই সেই জাদুকরী কাজগুলো করে দেখাচ্ছেন, যেগুলোর গল্প তারা এতদিন শুনে এসেছে।”

এই গল্পের নাম সুইজারল্যান্ডে ‘Hyylgschichte’— বাসেলের কার্নিভাল ঘিরে বলা এক ধরনের আবেগঘন নাটকীয় উপাখ্যান, যেখানে দুঃখ, ক্লান্তি ও আনন্দ একসাথে মিশে যায়। ঠিক যেমনটি এই দলটির সঙ্গে ঘটেছে— যারা মাত্র এক মৌসুম আগে লড়ছিল অবনমন ঠেকাতে। এবার সেই দলই শিরোপাজয়ী, এবং তার কেন্দ্রে এক রাজপুত্র— যিনি ফিরে এসেছেন নিজের নগরে, নিজের ক্লাবে।

এবার শুধু অপেক্ষা জুন ১ তারিখের সুইস কাপ ফাইনালের। যদি জিতে যান, তবে হবে ডাবল। আর যদি না-ও জেতেন, তবুও শাকিরির এই মৌসুম থেকে ফুটবল শিখবে— প্রত্যাবর্তন, প্রেরণা আর ভালোবাসার ভাষায়। সেই ভাষার নাম— জেরদান শাকিরি, যাকে ভক্তরা আদর করে ডাকতো ‘সে আমাদের সুইস মেসি।’

আরও পড়ুন: প্রিমিয়ার লিগে আবারো কি ফিরবেন হামজা?

আরও খবর

একটি মন্তব্য করুন

দয়া করে আপনার মন্তব্য লিখুন
দয়া করে এখানে আপনার নাম লিখুন

সর্বশেষ খবর

জনপ্রিয় খবর