লিটন দাস—বাংলাদেশ ক্রিকেটের অন্যতম প্রতিভাবান ক্রিকেটারদের একজন, ক্রিকেটীয় সৌন্দর্যের দিক থেকে যিনি হয়তো সমসাময়িক ব্যাটারদের মাঝে সবার উপরে থাকবেন। ব্যাট হাতে তার নিখুঁত টাইমিং, গ্রেসফুল শটমেকিং আর রুচিশীল স্ট্রোকপ্লে ক্রিকেটপ্রেমীদের চোখে শিল্পের মতো। সেই শিল্পে মুগ্ধ হয়েই ২০১৯ বিশ্বকাপে ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে ক্যারিবীয় কিংবদন্তি ইয়ান বিশপ তাকে ‘মোনালিসা’ আখ্যা দিয়েছিলেন। কিন্তু এ রকম সৌন্দর্যবোধের ভিতরেও থেকে যায় কিছু ব্যাকরণগত ফাঁকফোকর। বিশেষ করে যখন তিনি অফ ফর্মে থাকেন, তখন দেখা যায় শড় সিলেকশনে বেখেয়ালি, আর সেই বেখেয়ালিতে তিনি খুব দৃষ্টিকটু আউট হয়ে হতাশ করেন ভক্তকূলদের। লিটনের শট সিলেকশনের দুর্বলতা নিয়ে আলোচনা করলে এসে পড়ে তার ওয়েট ট্রান্সফার কিংবা হেড পজিশনের মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ও। ক্রিকেটের এই জটিল দিকগুলো বিশ্লেষণ করেছেন ক্রিকেট বিশ্লেষক সৈয়দ আবিদ হুসাইন সামি।

আরও পড়ুন: ইনজুরির কবলে সিরিজ শেষ তোফায়েলের, বদলি রিজওয়ান
অন ফিল্ড এর সিইও এবং ক্রিকেট বিশ্লেষক সৈয়দ আবিদ হুসাইন সামির মতে, লিটনের ব্যাটিং মূলত টাচ নির্ভর। তিনি ‘পাওয়ার হিটার’ নন, বরং টাইমিং নির্ভর একজন ব্যাটার। আর তাই তার মতো ব্যাটারদের জন্য ফ্রন্ট ফুটে সঠিক ওয়েট ট্রান্সফার অত্যন্ত জরুরি। ক্যারিবীয়দের বিপক্ষে সদ্যসমাপ্ত সিরিজে লিটনের পারফরম্যান্স ছিল হতাশাজনক। সেই সিরিজে সাদা বলের দুই ফরম্যাটে লিটন ৬ ইনিংস খেলে রান করেছেন— ২, ৪, ০, ০, ৩ এবং ১৪! সৈয়দ সামির পর্যবেক্ষণে উঠে এসেছে—এই ব্যর্থতার পেছনে ছিল তার ফ্রন্ট ফুটে নিজের শরীরের ভর ট্রান্সফার করতে না পারার প্রবণতা।
অধিকাংশ সময় লিটন তার ফ্রন্টফুটে ওয়েট ট্রান্সফার করতে ব্যর্থ হয়েছেন, যে কারণে শট খেলার সময় লিটনের ফ্রন্ট ফুটের পজিশনিং ঠিক ছিল না, বেকায়দায় ছিল।

আরও পড়ুন: ভারতে ফিরছে আইপিএলের বিদেশি ক্রিকেটাররা
লিটন যেহেতু টাইমিং নির্ভর প্লেয়ার, তাই ফ্রন্টফুট বেকায়দার থাকায় শট খেলতে পারেননি এবং দৃষ্টিকটু ভাবে আউট হয়েছেন। আবার লিটন যেসব বল ভালো খেলেছেন, সেগুলোতে দেখা গেছে—তার ফ্রন্ট ফুটের পজিশন সঠিক ছিল, ওয়েট ট্রান্সফার যথাযথ ছিল, যার ফলে হেড পজিশন বলের লাইনে ছিল। আর এখানেই এসেছে আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ ব্যাটিং উপাদান—হ্যান্ড আই কো-অর্ডিনেশন।

আরও পড়ুন: বাভুমার নেতৃত্বে প্রোটিয়াদের শক্তিশালী স্কোয়াড, ফিরলেন এনগিডি
বিশেষ করে ২০২২ টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে ভারতের সাথে ২৭ বলে ৬০ রানের বিস্ফোরক ইনিংসের উদাহরণ টেনে সৈয়দ সামি বলেন যে, লিটন সে ম্যাচে কিভাবে টাইমিং এর উপর নির্ভরশীল হয়ে ওরকম একটা ২২২ স্ট্রাইকরেটের ইনিংস খেলেছিলেন। যেহেতু লিটনের ট্রিগার মুভমেন্ট ছোট, তিনি বলের লাইন বুঝে খেলার উপর নির্ভর করেন। তাই এই হ্যান্ড-আই কো-অর্ডিনেশনের ঘাটতি হলে তার টাইমিং ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
অথচ যেসব বল ঠিকঠাক পজিশন নিয়ে খেলেছেন, সেগুলোতে ছিল আত্মবিশ্বাস, শট সিলেকশনও ছিল যথাযথ। কিন্তু বেশিরভাগ ডিসমিসালের সময় দেখা গেছে তিনি বোলার বল ছোড়ার পর দ্রুত পজিশন নিতে ব্যর্থ হয়েছেন, আর তার ফলেই ওয়েট থেকে হেড, সব কিছুই ছন্দপতনে গেছে। যেখানে ফ্রন্ট ফুটে ওয়েট ট্রান্সফার ঠিকমতো হয়েছে, সেখানে দেখা গেছে লিটনের শট একুরেসি অনেকটাই বেড়ে গেছে। এ যেন ব্যাটিংয়ের সেই সূক্ষ্ম ব্যাকরণ, যেটা ভঙ্গ করলে পুরো কাঠামোটাই ভেঙে পড়ে।
২০২৪ সালটা দুঃস্বপ্নের মত কাটিয়েছেন লিটন, পাকিস্তানের বিপক্ষে টেস্ট সিরিজ বাদ দিলে অন্য কোথাও ধারাবাহিকতা রাখতে পারেননি লিটন। ২০২৫ সালে এখনো খেলেননি আন্তর্জাতিক কোনো ম্যাচ। তবে সেই অফ ফর্মের লিটনের কাঁধেই এখন দেশের টি-টোয়েন্টির দায়িত্ব। তাই শুধু ব্যাটার হিসেবেই লিটনের দায়িত্ব আছে, ব্যাপারটা এমন নয়, বর্তমান টি-টোয়েন্টি অধিনায়ক হিসেবেও লিটনের কাঁধে এখন দায়িত্ব অনেক। লম্বা সময় অধিনায়কত্ব পাওয়ায় দলকে গুছিয়ে নেওয়ার সুযোগ থাকছে পর্যাপ্ত। লিটনও তাই ভবিষ্যতের রূপরেখা গড়ে তুলতে চান ধাপে ধাপে। তিনি মনে করেন, এই সময়টা হবে বাংলাদেশের জন্য কিছু বড় করে দেখানোর সুযোগ। লিটন বলেন, “আমি চাই, আমার হাত ধরে বাংলাদেশে যেন কিছু বড় কিছু আসে।” তবে শুধু দলীয় সাফল্য নয়, নিজের পারফরম্যান্সের বিষয়টিও সামনে এনেছেন লিটন, কারণ তিনি জানেন, বিগত বছর প্রত্যাশা অনুযায়ী হাসেনি তার ব্যাট, সাম্প্রতিক সময়টায় দলকে ব্যাটার হিসেবে সেভাবে অবদান রাখতে ব্যর্থ হয়েছে তিনি, এ নিয়ে সচেতন তিনি নিজেও। লিটনের আশা, দ্রুত ফর্মে ফিরে এসে দলের জন্য অবদান রাখতে পারবেন, এজন্য লিটন তার ছোট ছোট দুর্বলতা নিয়ে কাজ করবেন, হয়তো ফ্রন্ট ফুটের এই ওয়েট ট্রান্সফারিং নিয়েও কাজ শুরু করেছেন তিনি। ব্যাটার লিটন অধিনায়ক হিসেবেও বেশ সিরিয়াস। তার মতে, “সব খেলোয়াড় যেমন চায় ম্যাচে পারফর্ম করতে, ঠিক তেমনি প্রতিটি অধিনায়কও চায় দলকে জেতাতে। আমারও সেই ইচ্ছা থাকবে। আর আমি যত দ্রুত ফর্মে ফিরতে পারব, ততই দল উপকৃত হবে।”আপাতত লিটনের সামনে চ্যালেঞ্জ—২০২৬ বিশ্বকাপ পর্যন্ত বাংলাদেশকে নেতৃত্ব দিয়ে প্রস্তুত করা একটি প্রতিযোগিতামূলক দল, যে দল নিয়ে স্বপ্ন দেখবে বাংলাদেশের ক্রিকেটপ্রেমীরা। তবে তিনি নিজেই স্বীকার করেছেন তার অফ ফর্ম নিয়ে, এবং বলেছেন তা কাটিয়ে উঠতে চান। কারণ তিনি জানেন—তিনি ভালো খেললে দল উপকৃত হবে। বাংলাদেশের অন্যতম প্রতিভাবান এই ব্যাটারের প্রতি দেশবাসীর প্রত্যাশা সবসময়ই একটু বেশি। তাই লিটনের ক্রিকেটীয় ব্যাকরণগত ত্রুটিগুলো শুধরে আবারও যেন ব্যাটিং শিল্পের সেই সৌন্দর্য মঞ্চে উঠে আসে—এ প্রত্যাশাই থাকে সব ক্রিকেটপ্রেমীর।